শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বন্ধন দরকার

আপডেট : ০৩ জুন ২০২০, ২২:১৩

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

শিক্ষাক্ষেত্রে একসময় প্রাচীন ভারতে গুরু-শিষ্যের ধারণা প্রচলিত ছিল, যা এখন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অংশ। প্রকৃতির উদার আলোয় গুরুর অন্তর্নিহিত দর্শনভিত্তিক সার্বজনীন জ্ঞান উত্সারিত হয়ে শিষ্যের মন ও মননশীলতাকে বিকশিত করত। গুরুর নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে শিষ্য বহুমাত্রিক জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে তার মন ও আত্মার ক্ষুধা মেটাত। সময়ের বিবর্তন ও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে  শিক্ষা ক্রমাগত প্রকৃতির আলো, বাতাস ও উদারতাকে নির্বাসিত করে চার দেওয়ালের কৃত্রিম গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। গুরু-শিষ্য মতবাদ আধুনিকতার নাম নিয়ে ছাত্র-শিক্ষককের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হলো। খুব নিবিড় বন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ছেলেদের মানুষ করে তোলার জন্য যে যন্ত্র তৈরি হয়েছে তার নাম ইস্কুল এবং সেটার মধ্য দিয়ে মানবশিক্ষার সম্পূর্ণতা হতে পারে না। শেক্সপিয়ারও এমনটাই ভেবেছেন। শেক্সপিয়ার তার ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটকের একটি সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে—বালকটি স্কুলে যাচ্ছে নিতান্ত শম্বুক পায়ে, অনিচ্ছাসহকারে। এসব নিতান্তই অনেকের কাছে প্রাচীনতা মনে হতে পারে কিন্তু ফেলে আসা শিক্ষা পদ্ধতিতে যে প্রাণ ও প্রকৃতির যোগ ছিল সেটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে। এর সঙ্গে মানুষের মন ও কৌশলও বদলেছে। সেটা মানবিক সভ্যতার বিকাশে সহায়ক শক্তি হবে, নাকি এটি মানুষকে আসলে যান্ত্রিক করে তুলবে সেটা সময় আর ইতিহাস বলবে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ গেটে লেখা আছে কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এর জন্য কেবল শিক্ষার মান হ্রাস করা এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার অনুমতি দেওয়াই যথেষ্ট। শিক্ষাক্ষেত্রে যে কোনো পরিবর্তনের আগে আমাদের এই বিষয়ই বারবার ভেবে দেখতে হবে। কেননা কোনো একটি কৌশল বা পরিকল্পনার নেতিবাচক ফলাফল যাতে আগামী প্রজন্মকে বহন করতে না হয়। সময়ের বিবর্তনে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে সাদা চক ও ব্ল্যাক বোর্ড এসেছে। সাদা চক থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন শিক্ষককের পুঞ্জীভূত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর স্বপ্ন দেখানোর জাদুকরি শক্তি। অতীতে আমরা যে পরিমাণ জ্ঞানতাপস ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিক্ষকদের পেয়েছি, এখন তেমনটি আর পাচ্ছি না। বড়ো মাপের ভালো শিক্ষকের দৈন্য লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রযুক্তি শিক্ষাকে যত সহজ করেছে, বিখ্যাত ও বড়ো মাপের ভালো শিক্ষকদের সংখ্যা তত কমেছে। এর কারণ শিক্ষকরা তাদের নিজেদের ভেতরের জ্ঞানের বিকাশ ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে সৃজনশীলতাকে ব্যবহার না করে প্রযুক্তির ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যান্ত্রিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু নিজের মেধা দিয়ে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তবে এর যে ব্যতিক্রম নেই তা বলাও যাবে না, তবে সেটা সংখ্যাগত দিক থেকে অতি নগণ্য। এটাও একধরনের ধারণাপ্রসূত লজিক হতে পারে কিন্তু বিষয়টিকে ভেবে দেখারও প্রয়োজন আছে। এটি প্রযুক্তির দোষ নয়, প্রযুক্তির ওপর মানুষের অতিনির্ভরতা এর জন্য দায়ী। ফরাসি দার্শনিক মোঁতেইন লিখেছেন জ্ঞানে ভরা মাথা নয়, শিক্ষকের হবে জ্ঞানে বিকশিত মাথা। মোঁতেইন শিক্ষককে অনুকরণ করে গতানুগতিক শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে সমর্থন করেননি। তিনি মনে করেন, শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের পথ দেখিয়ে দেবেন, আবার কখনো শিক্ষার্থীকে নিজেই জ্ঞানের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবেন। শিক্ষার্থীকে তিনি প্রশ্ন করতে দেবেন সক্রেটিসের মতো, প্রশ্ন করতে শেখাবেন। তিনি সব সময় বলতেন একটি ভালো প্রশ্ন হাজারো অনুপযুক্ত উত্তরের চেয়ে উত্তম। শিক্ষায় জ্ঞান কখনো একটি গণ্ডির মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে সংকীর্ণতা তৈরি করবে না বরং জ্ঞান থেকে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষা অগ্রসরমাণ রূপটি বিকশিত হবে। যার প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়ে আরো প্রাচুর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইতিহাস ও সময় সক্রেটিসকে একজন মহান ও বিখ্যাত শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যিনি প্রথাগতভাবে কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার কোনো শিক্ষায়তন ছিল না, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, যেখানেই তিনি পা ফেলবেন সেখানেই শিক্ষায়তন গড়ে উঠবে। তিনি পৃথিবীকে শিখিয়েছেন কীভাবে একজন মানুষের মধ্যে শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষায়তনের সম্মিলন ঘটতে পারে। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় আমরা এমন শিক্ষকদের আর খুঁজে পাচ্ছি না। এর ফলে সাধারণ মানুষকে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আবার যাদের পক্ষে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না তারাও সক্রেটিসের মতো শিক্ষকদের দেখা পাচ্ছে না। কিংবা এমন পদ্ধতিতেও যে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষককের ধারণা গড়ে উঠতে পারে, সেটাও মানুষের ভাবনাতে নেই। এর কারণ, আমরা শিক্ষাকে নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে এর বিকাশকে রুদ্ধ করেছি। মনে হতে পারে পুরাতন রীতির শিক্ষা পদ্ধতি, সেখানে কি ফিরে যাওয়া উচিত? উচিত কি উচিত নয়, সে তর্কে-বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই; কিন্তু শিক্ষার সেই ধারা কখনো প্রাচীন হয় না। বরং প্রাচীন হয়েছে আমাদের মন। সে কারণে শিক্ষার আধুনিকতার কথা বলে আমরা জীবন সম্পৃক্ত শিক্ষাকে বিসর্জন দিয়েছি। অনেক সময় আমরা ভুলে যাই, আমাদের শিক্ষাকে আমাদের জীবন, ভৌগোলিক অবস্থান ও সংস্কৃতির মতো করেই সাজাতে হবে, ধার করা উন্নত বিশ্বের শিক্ষা আমাদের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। তবে উন্নত বিশ্বের শিক্ষার ভালো উপাদানসমূহ গ্রহণ করতেও আমাদের কার্পণ্য করা উচিত নয়। কৃত্রিম শিক্ষা কখনোই জীবনসম্পৃক্ত শিক্ষাকে অতিক্রম করতে পারে না। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যেমন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজস্ব দর্শন মেনে চলতেন। রসায়নকে তিনি সাহিত্যের মতো করে পড়াতেন। তিনি সব সময় বলতেন, একজন শিক্ষক ‘সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্তু পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।’ তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনাজীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমতো আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্রছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনো কোনো নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরণ করে পাঠদান দিতাম না।’ পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে জ্ঞানের পরিধি বিদ্যমান তা তিনি ছাত্রদের বুঝাতে পেরেছিলেন। জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে তার এই উদার মনোভাবাপন্ন ধারণা পরবর্তী সময়ে তার ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। এর ফলে তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।’ তার কৃতী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ড. মেঘনাথ সাহা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমানবিহারী দে, ড. কুদরাত-এ-খুদা, প্রিয়দাভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জি প্রমুখ। প্রেসিডেন্সি কলেজে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকও তার ছাত্র ছিলেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার স্বরূপ বদলাবে—এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা যেন নিজের আত্মপরিচয়ের শেকড়কে না হারায়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

n লেখক:শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর