শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ওবামার দেশে কালোদের লড়াই

আপডেট : ০৩ জুন ২০২০, ২২:১৩

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০০৮ সালে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামাকে প্রসিডেন্ট নির্বাচন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব ভেবেছিল কট্টর বর্ণবাদী মার্কিন সমাজের মানসিকতায় হয়তো পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু  বর্ণবাদ যে আমেরিকার সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে তার প্রমাণ সাম্প্রতিককালে আরেক কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লোয়েড হত্যা, বিক্ষোভ ও কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্টের ফ্যাসিবাদী আচরণ।

ঘটনার সূত্রপাত গত ২৫ মে আমেরিকার মিনিসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে ড্রেক শোয়িন নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার জর্জ ফ্লোয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে পাশবিক কায়দায় হত্যাকে কেন্দ্র করে। ভিডিওতে দেখা যায় ঐ পুলিশ কর্মকর্তা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ফ্লোয়েডের ঘাড়ে তার হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে দ্রুত মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। শোয়িনকে ২৯ মে তে গ্রেফতার করা হলেও মাত্র ৫০০ ডলার মুচলেকায় জামিন দেওয়া হয়েছে।

উত্তেজিত মার্কিন জনতা সমগ্র আমেরিকায় ফ্লোয়েড হত্যাসহ বর্ণবাদ বিরোধী ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং তাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আদেশ অনুযায়ী বিক্ষোভ দমনে ন্যাশনাল গার্ড যেভাবে কঠোর অভিযান চালিয়েছে বিক্ষোভকারীদের ওপর, ট্রাম্প তাতে খুশি হয়ে ঐ বাহিনীকে অভিনন্দিত করে টুইটারে বার্তাও দিয়েছেন। তবে বিক্ষোভ দমাতে জরুরি অবস্থা জারি, কারফিউ ও প্রেসিডেন্ট নানা হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও মানুষ রাজপথ ছাড়ছে না।

ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মি. হ্যারিস পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লোয়েড হত্যার সমালোচনায় বলেছেন, মার্কিন রাজপথ কৃষ্ণাঙ্গদের খুনে ঢেকে গেছে। ক্লিনটন আমলের শ্রমমন্ত্রী রবার্ট রাইস লিখেছেন, আজকের আমেরিকার যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার কোনো ফারাক নেই। এ দেশে দাসপ্রথার অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এক ভিন্ন দাসপ্রথা চালু হয়েছে। আমেরিকার শেকড় থেকে শিখরে বর্ণবাদ। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরতে পরতে সাদা-কালো বৈষম্য। সমাজ ব্যবস্থার গভীরভাবে প্রোথিত আছে বর্ণবাদ। সাদা-কালো বিদ্বেষ।’ বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদি প্রবাহ ও আমাদের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়।’

মার্কিন সমাজের এই বর্ণবাদী আচরণের ইতিহাস দীর্ঘ। কালোদের মানুষ হয়ে উঠার লড়াইটাও দীর্ঘদিনের। ফ্লয়েডের মতো আরেক কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নারকেও ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ দম বন্ধ করে হত্যা করেছিল। খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে এই সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গত ১৩ মার্চ লুইভিলের কেন্টাকিতে ২৬ বছর বয়সি জরুরি চিকিত্সা বিষয়ক প্রকৌশলী ব্রেওনা টেইলারকে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ অফিসাররা আটবার গুলি করে হত্যা করে।

গত শতকে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে তোলেন। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে লুথার কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিংকে মারা যেতে হলো। বিশ্ব যখন লুথার কিংয়ের ৫২তম হত্যা দিবস পালন করছে তখনো হতাশা আবার তার রূপ প্রকাশ।

ভূতের উলটো পায়ে ভর করে আমেরিকার মানুষ ফিরে যাচ্ছে বর্ণবাদী অতীতের আবর্তে। আর এই উলটো যাত্রায় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের চালিত করছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্টই। আমেরিকার মসনদে বসে তিনি আমেরিকাকে বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন করে কট্টরবাদের চাষে নামলেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শব্দবন্ধটি দিয়ে। এই যেন পূর্বসূরি ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ এর এক সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া। বিশ্ব ইতিহাস বলে অভিবাসনের এই দেশে আমেরিকায় কেউই আগন্তুক নয়। বাঁচার সমঅধিকার রয়েছে সাদা-কালো-হলদে সব মানুষেরই। একটি দেশের প্রেসিডেন্টের উচিত বিভিন্ন মত ও পথের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা নয়। তার ঠিক বিপরীতে ট্রাম্পের বর্ণবাদী চিন্তার ফলে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ আমেরিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সহমর্মিতা জানালেও বর্ণবাদী ট্রাম্পের টনক আদৌ নড়বে কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তবে কি করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থ ট্রাম্প নিজ দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে ও আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের জাতীয়তাবাদী ধোঁয়া তুলে জেতার পরিকল্পনা থেকে বর্ণবাদকে উসকে দিচ্ছেন!

n লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়