বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনা নয়, বিষণ্নতা শাসন করছে মনোজগত্

আপডেট : ০৩ জুন ২০২০, ২২:১৩

ফারহানা নওশিন তিতলী

বিপদ যেন কোনোভাবেই কাটছে না। প্রতিদিনের অজস্র মানুষের প্রার্থনার অন্তর্বিন্দু এই করোনা ভাইরাস। সবাই একটু করে আশার আলো দেখছে আবার ঠিক পরক্ষণেই সেই আলো নিভে যাচ্ছে। কারণ কোনো গবেষণাই সাম্প্রতিক সময়ের এই বিপর্যয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। পৃথিবীর মানুষগুলো যেন আজ অভিশপ্ত। এই প্রাকৃতিক অভিশাপ কবে নাগাদ কাটবে তা কারোরই জানা নেই। সুন্দর একটি পৃথিবী আদৌ সবাই দেখতে পারবে কি না তাও অনিশ্চিত। কতজন সৌভাগ্যবান বেঁচে থাকবে আর কতজন এই ধরণী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে তা মানুষের কল্পনাতীত। প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যত্ এক অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে আছে। এত শত অনিশ্চয়তার মধ্যে মানব মন এখন সবচেয়ে বেশি যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে সেটি হলো মানসিক অবসাদ। করোনা ভাইরাস নয়, বিষণ্নতাই এখন শাসন করছে আমাদের মনোজগত্। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দীর্ঘ আড়াই মাস শিক্ষার্থীরা যার যার বাড়ির মধ্যে আটকে আছে। মহামারি এ ভাইরাসে প্রাণনাশের শঙ্কা, একঘেয়েমি জীবন ও প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হচ্ছে শিশুরা। একই জায়গায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে শিশুদের মানসিক অবক্ষয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেশন জট, অনেক পরিবারে দরিদ্রতা, পারিবারিক কলহ, এই দুর্যোগের কোনো স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় একঘেয়েমি সময় পার করতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে তারা।

এমন পরিস্থিতি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে বড়ো ধরনের হুমকির সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডেভেরো কেসটেল মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন এবং নীতি-নির্দেশিকা পেশ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বলেন, আইসোলেশন, অনিশ্চয়তা সামাজিক দুরাবস্থা বর্তমানে মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশ্বে ব্যাপক ও ভয়াবহ মাত্রায় মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

লকডাউনের ফলে শিশুসহ বেশির ভাগ  তরুণ-তরুণী অবসর যাপন করতে অনলাইন নির্ভর হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশির ভাগ মানুষের স্ট্যাটাস এই করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত এবং একঘেয়েমিকে কেন্দ্র করে। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবার মুখে যেন একটাই শব্দ ‘ভাল্লাগেনা’। কবে নাগাদ যে পৃথিবী সুস্থ হবে এবং সবার মন ভালো হয়ে যাবে তা শুধুই কল্পনা সদৃশ। এইতো কিছু দিন আগে সবাই কত ভালো ছিলাম! ব্যস্ততা, আনন্দ, কষ্ট সবকিছু মিলে জীবনে একটা ছন্দ ছিল। কিন্তু এই মহামারি সব অনন্দ অভিলাষকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

তবে বিপদ যখন এসেই গেছে, অন্ধকার কেটে একদিন নতুন ভোর আসবেই। হয়তো নতুন ভোর আসতে একটু বিলম্ব হচ্ছে, কিন্তু এমন তো নয় যে, নতুন ভোর কখনও আসবে না! পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত মানব জাতিকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে মানুষ কিন্তু পিচঢালা রক্তের বিনিময়ে হলেও ঠিকই সেই বিপদের মোকাবিলা করেছে এবং জয়ীও হয়েছে। বর্তমান সময়টাও ঠিক তেমনি। বিভিন্ন দেশের চিকিত্সক, বিজ্ঞানীরা দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই মহামারির স্থায়ী সমাধানের জন্য। তাদের পরিশ্রম যাতে সফল হয় সেজন্যে হলেও এখন আমাদের ঘরেই থাকতে হবে। এই কঠিন সময়টাতে ধৈর্য না হারিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করা যাক কিভাবে ঘরে থেকে ভালো থাকা যায়। মানসিকভাবে আরো শক্ত হয়ে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের এই বিপদ মোকাবিলায় তারা যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখি। বাড়ির পাশে একটু উঁকি দিয়ে দেখতেই পারি গরিব প্রতিবেশীরা কিভাবে দিনাতিপাত করছে। তাদের বিপদে নিজেদের কোনোভাবে কি কাজে লাগানো যায়? আর মনে মনে আস্থা রাখি সেই ভোর দেখার, যে ভোরে থাকবে না করোনাতঙ্ক। সূর্যের নির্মল হাসির সঙ্গে সঙ্গে যেন আমরাও প্রাণ খুলে হাসতে পারি। আবার যেন মেতে উঠতে পারি বন্ধুদের সঙ্গে টঙের দোকানের চায়ের কাপের এক চুমুকে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার আড্ডায়।

n লেখক :শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ