মোহন মিয়ার জন্ম এমন এক সময়, যখন এ দেশের মুসলমান সমাজ শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। কিশোর বয়স থেকেই স্বজাতির কীসে মঙ্গল হবে—এ চিন্তায় তিনি বিভোর থাকতেন। ফরিদপুর শহরে সে সময় মাত্র চার-পাঁচ ঘর মুসলমান পরিবার সচ্ছল অবস্থার অধিকারী ছিল। বাকি সবারই ছিল জরাজীর্ণ দশা।
মোহন মিয়ার বয়স যখন ১৮ বছর তখন তার পিতা ময়েজউদ্দিন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বড় ভাই লাল মিয়া কংগ্রেস রাজনীতিতে ব্যস্ত। ফলে জমিদারি পরিচালনার গুরু দায়িত্ব মোহন মিয়ার স্কন্ধেই পতিত হলো। তরুণ বয়সে এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নিজে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও সমাজে শিক্ষার আলো বিস্তারে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, তার ফলে ব্যক্তিজীবনের এ ক্ষতি পুষিয়ে যায়।
ফরিদপুর শহর ছাড়া তদানিন্তন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অন্যত্র কোথাও শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি যখন ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, তখন শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেলা বোর্ড তহবিল হতে অনেক সময় নিয়মের বাইরেও অর্থ সাহায্য দান করেছেন। রাজেন্দ্র কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা উন্নয়নের ব্যাপারে জেলা বোর্ড তহবিল থেকে এ রকম সাহায্য দান করে তিনি প্রবল অডিট অবজেকশনের সম্মুখীন হলে তিনি জবাব দেন যে, ‘জেলা বোর্ডের টাকা জনগণের। জনগণের টাকা দিয়ে জনগণের কাজ করেছি, এ টাকা তো আমার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করিনি। সুতরাং আমি কোনো অন্যায় করিনি।’
শিক্ষা সম্বন্ধে মোহন মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি খুব বাস্তবমুখী ছিল। তিনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রেখেই ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে ‘বায়তুল আমান’ নামে একটি কৃষি শিল্প শিক্ষা প্রকল্প চালু করার প্রয়াস পান। এই উপলক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৮ জানুয়ারিতে তিনি এক সম্মেলনের আয়োজন করেন।
মোহন মিয়া সাহেব মূলত রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে তার রাজনীতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অন্যদের এগিয়ে নিয়ে নিজে পেছনে থাকা পছন্দ করতেন। এজন্য বিভাগ পূর্ব কালে তো বটেই, পাকিস্তান আমলেও তার পরিচিত ছিল ‘কিং মেকার’ রূপে। গুণী ও উপযুক্ত লোকদের প্রতি তিনি বরাবর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বহুবার প্রকাশ্য সভায় বলেছেন, তিনি আলিমুজ্জামান চৌধুরী, মৌলভী তমিজউদ্দিন খাঁর মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সংস্পর্শে কাজ করতে পেরে ধন্য হয়েছেন।
জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে মোহন মিয়ার কার্যকাল ছিল নানা কারণে উল্লেখযেগ্য। তিনি সারা জেলাব্যাপী রাস্তা ঘাট, পুকুর খনন, মকতব, মাদ্রাসা, স্কুল দাতব্য চিকিত্সালয় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ব্যাপারে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মোহন মিয়ার চেয়াম্যান আমলে সারা বাংলাদেশে ফরিদপুর জেলায় সর্বাধিকসংখ্যক নলকূপ খনন করা হয়।
মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর শেরে বাংলা মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং পরে সদলবলে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা যখন মুসলিম লীগদলীয় প্রধানমন্ত্রী তখন মোহন মিয়া ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে শেরে বাংলা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠন করলেও মোহন মিয়া মুসলিম লীগেই থেকে যান।
ফরিদপুর জেলায় পাকিস্তান আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া। ১৯৪০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত একটানা তিনি ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একপর্যায়ে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ায় তিনি ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেন এবং পরে শেরে বাংলা গঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। এই পার্টির নমিনি হিসেবে তিনি যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি কিছুদিনের জন্য ফজলুল হক কেবিনেটে মন্ত্রিত্বও করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা এক রকম রহিত হয়ে যায়। সেই ঘোর দুর্দিনে ষাটের দশকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠিত হয়, তার অন্যতম নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী। ১৯৭১ সালের করাচিতে অবস্থানকালে ২৬ নভেম্বর তারিখে তিনি অকস্মাত্ ইন্তেকাল করেন। এভাবেই এদেশের জাতিসত্তার এক মহান সেবকের জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘোষিত হয়।
দোষে-গুণে মানুষ। মোহন মিয়া সমস্ত ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন—এমন কথা নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না। আজীবন রাজনীতি করেছেন বলে তার বিরোধীদের সংখ্যা মোটেই কম ছিল না। তবুও তার সান্নিধ্যে যারা গেছেন, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করতেন, দেশ ও সমাজের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনকালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ একবার বলেছিলেন—‘যদি আটাশটি জেলায় আটাশ জন মোহন মিয়া পেতাম, তবে অনেক আগেই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম’ কথাটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ।
n লেখক :সমাজকর্মী