শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার!

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২১, ২১:০১

টিনএজ ফ্রাস্টেশনের অন্যতম প্রধান উত্স হচ্ছে নিজের ভবিষ্যেক খুব একটা স্পষ্ট দেখতে না পাওয়া। বাবা-মা চাইছেন এক রকম, সেই রকমের সঙ্গে মিলছে না নিজের পছন্দ। ওদিকে যে ক্যারিয়ার কপালে জুটবে, তা দিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যাবে কি না, টিকে থাকতে পারব কি না, ইত্যাকার নানান দৃশ্য টিনএজারের জীবনে বৈসাদৃশ্য ঘটিয়ে দেয়। ভাবনার হাত থেকে আপাতত মুক্তি পেতে অথবা ভাবনাকে ‘এ্যায়সা কায়দায়’ ট্যাক্ল দিতে পারার মতো করে নিজেকে সুপার হিউম্যান ভাবতে টিনএজার তখন আশ্রয় খোঁজে মাদক কিংবা এরকম অন্ধকার চোরাগলিতে। বেচারার হাত ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সহানুভূতিশীল মানুষের তখন বড্ড অভাব পড়ে যায়। বাবা-মা নিজেরাই পরিণত হন সমস্যায়, সমাধান আর দেবেন কী! এরকম কৈশোরের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই দেখা হয়ে যাচ্ছে। কী অসহায়ত্ব ঘিরে ধরেছে ওদের, কী অসহায় সময় পার হয়ে এসেছি আমরাও! সমাজ কেবলি বলে, নিজের পায়ে দাঁড়াও। বলে, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। বলে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হও।

‘বলেই খালাস’, এভাবেই খেদ ঝরে পড়েছিল ইমরানের কণ্ঠে। ওর ঠোঁটের কোণে ঝরে পড়া তিক্ত হাসির খোঁচা বলাবলির ঊর্ধ্বে পৌঁছে যেতে বলে।

‘হয়ে ওঠার অপশন খুব কম। যেন এর বাইরে আর কিছু হওয়া চলে না।’ এই রাগ ছিল মিথিলার।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-গাড়িঘোড়াওয়ালা ছাড়া আর কী হতে চাও? এরকম প্রশ্ন যখন করেছিলাম, ওর চোখে অসহায় দৃষ্টিশূন্যতা দেখেছি। আর কী হওয়া যায়? কেন কিছু হতে হবে?

খুব দার্শনিক ছিল শুভ্র। বলছিল, ‘টাকাপয়সা কামানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। টাকাপয়সা কামানোর জন্য একটি ক্যারিয়ার বেছে নেব আর তাতে আমার মন শান্তি পাবে না, তেমন তো আমি চাই না।’

বলেছিলাম, মনকে প্রশ্ন করো, মন কী চায়? না না, মনকে প্রশ্ন করার কাজটি যেনতেনভাবে করলে হবে না। তোমার মন তোমার সঙ্গে কখন কীভাবে দেখা দেয়, সেটা আগে জেনে নাও। কোনো মন খোলা আকাশের নিচে মেলে ধরে নিজেকে। কেউ আবার নিঃশব্দ গাছের কাছে গেলে নিজেকে খুঁজে পায়। তুমি আগে তোমার মনের মুখোমুখি হও। তারপর প্রশ্ন করো, কীসে তৃপ্ত হবে মন?

একবার নবারুণ পত্রিকা একগাদা শিশুকিশোরকে কাগজ-কলম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, কী হতে চাও লিখে ফেল। কেউ কেউ আকাশ হতে চাইল। কেউ চাইল পাখি হতে। কেউ গাছ।

এরা খোলা আকাশ দেখে না, খোলা মাঠে ছোটে না। তাই কিছু হতে চাইতে গেলে মনটা চুপিচুপি বলেছিল, মুক্তি চাই। মুক্তি মানে আকাশ, গাছ, পাখি।

ক্লাস সেভেনে পড়া শেক্সপিয়ার সেদিন বলছিল, ও নাকি এমন এক গাড়ি বানাবে, যা কেউ এখনো দেখেইনি। গাড়ির প্রতি ওর ঝোঁক দেখে ওর মায়ের কপালে অসংখ্য ভাঁজ। কে ওকে গাড়ি বানানোর সুযোগ দেবে? কী হবে এই ছেলের? কী হবে ওর ভবিষ্যত্?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গত্ বাঁধা কিছু টিপস দিতে পারে, এমএ পাশ করে সরকারি অফিসের পিওন পদে আবেদন জমা দিতেও কুণ্ঠিত অনুভব করে না। এভাবেই কেটে গেছে দিন, আমাদের দিন; কিন্তু এভাবে চিরকাল যাবে না। দুনিয়া বদলাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে ওঠার যুদ্ধে নেমেছে। আইডিয়ার সন্ধানে সরকারি অফিসে পর্যন্ত ইনোভেশন টিম গড়ে তুলে উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে আইডিয়ার। পৃথিবীর সম্পদ কমে যাচ্ছে, আইডিয়া দিয়ে ন্যূনতম সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন ছাড়া টিকে থাকা যাবে না, এটা সরকারি পর্যায়ে বোধগম্যতা এলেও সাধারণ জনগোষ্ঠী কি বুঝতে পেরেছে? আমি বুঝেছি? আপনি বুঝেছেন? আমরা সবাই কি বুঝতে পেরেছি? আর কত সময় লাগবে আমাদের সবাইকে বুঝে ওঠার সমান পর্যায়ে আসতে?

আর তাই, যত দিন যাচ্ছে টিনএজারের জীবনের আঁধার তত বেশি গাঢ় হচ্ছে। একালের টিনএজারের ওপর অভিযোগও আছে কম না। আমাদের কালে পৃথিবী চোখের পলকে কম্পিউটারের পর্দায় বা হাতের মোবাইলে হাজির হতো না। এখন হয়। মেকানিক্স বুঝতে পারছিলাম না বলে চোখের পানিতে খাতার পাতা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। এখন তো অসংখ্য শিক্ষণীয় সাইট আছে না বোঝাকে বুঝিয়ে দিতে। এরপরও ইন্টারনেটকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না নিয়ে গত্ বাঁধা ‘কোচিং সিস্টেম’ গিলছে কেন টিনএজাররা? কেন হতাশ হচ্ছে? ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত্ নিয়েও কি কম তথ্য আছে? কেন সেসব চেখে দেখছে না? ইন্টারনেট অনিরাপদ, সোজাসাপটা এ যুক্তি শুনতেও রাজি নই। নিরাপদ ইন্টারনেটকে কীভাবে চেনা যাবে, সেটা শেখার উপায়ও কিন্তু আছে ইন্টারনেটে।

বলছিলাম ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত্ নিয়ে কথা। মাইক্রোসফটের ওয়েবসাইটে একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। খুব বেশি দিন পরের ভবিষ্যত্ নয়, ২০২৫ সাল নাগাদ কোন কোন ক্যারিয়ার পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত দরকারি হয়ে উঠবে, তাই নিয়ে তথ্য আছে ওখানে। ২০২৫ সাল নাগাদ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হয়ে উঠবে লাখ লাখ মানুষের সময় কাটানোর প্রধান ডিজিটাল স্পেস। ওখানেই তারা থাকবে, কথা বলবে, শিখবে, খেলবে এবং কাজ করবে। গোটা বিশ্বকে দেখতে চাইলে জানালা খুলে তাকানোর দরকার পড়বে না। অনলাইনে যে দুনিয়া, সেটাই আসল দুনিয়া, হয়ে যাবে এরকম সব। এর আভাস পাচ্ছি কিন্তু এখনি। ২০১৭ সালে ১ কোটি ২০ লাখ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট বিক্রি হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ ভিআর প্রযুক্তির মার্কেট শেয়ার দাঁড়াবে বিশ্বব্যাপী ৪০ বিলিয়ন ডলার। আগামী দশকে স্মার্টফোনের জায়গা নেবে ভিআর প্রযুক্তি। তাই এই প্রযুক্তির দরকার পড়বে লাখ লাখ স্মার্ট তারুণ্যের, গত বছরই চীন প্রযুক্তি খাতের সেরা মেধাদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খুঁজে নিয়ে ভিআর প্রযুক্তিতে লাগিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের সঙ্গে হিসাব করলে ভিআর প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল চেয়ে করা চাকরির বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বেড়ে গেছে শতকরা ৮০০ শতাংশ। সব দেশ স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ভিআর প্রযুক্তি শিখিয়ে দক্ষ করতে চাইছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বে প্রথম শুরু হলো গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স, অস্ট্রেলিয়ার ডিয়াকিন ইউনিভার্সিটিতে। একই সময়ে লুজিয়ানাতে ডিজিটাল মিডিয়া ইনস্টিটিউট থ্রিডি মডেলিং, টেক্সচারিং, অ্যানিমেশন এবং মোশন ক্যাপচারিংয়ের ওপর দুইটি কোর্স চালু হয়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের স্থাপত্য, তেল-গ্যাস খাতে, রেলশিল্পে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীতে খুব শিগিগর যে ভিআর প্রযুক্তি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়বে, তাতে সুযোগ পেতে প্রস্তুত করা। অনলাইন গেমিং থেকে শুরু করে সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনে দ্রুত জায়গা করে নেওয়া ভিআর প্রযুক্তি তৈরি করছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ক্যারিয়ার।   

হতাশাগ্রস্ত টিনএজার ও তাদের বাবা-মায়ের এই রকম ক্যারিয়ার নিয়ে আগ্রহ কি জন্মাবে? হয়তো সোজা বাক্যটা উচ্চারিত হবে, আমরা কি পারব? ছা-পোষা মধ্যবিত্তের অত অ্যাডভেঞ্চার দরকার নেই। সোজাসাপটা একখানা চাকরি হলেই হবে। সরকারি চাকরি হচ্ছে প্রথম পছন্দ। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে চমত্কার রেজাল্ট করে শিক্ষাজীবন শেষ করা এক তরুণের মা আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি খুব মন খারাপ করে বলছিলেন, ছেলে যে কী আবোল-তাবোল বলে! সরকারি একটা চাকরি যদি হতো! এই ধরুন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার...!

কম্পিউটার সায়েন্স পড়া তরুণ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার পোস্টে আবেদন করেন, কোন চাপে করেন, তা বলাই বাহুল্য। এর পরও দেখা হয় বাঁধ ভেঙে দেওয়া তরুণদের সঙ্গে। সেই ফ্যাশন ডিজাইনার তরুণ যেমন মায়ের কথামতো নিজের গলা নিজে টিপে বসেননি। ফ্রিল্যান্সার শুভ তৈরি করে দিয়েছেন ‘নবারুণ মোবাইল অ্যাপ’। সামাজিক নিরীক্ষণে তার এই কাজ কোনো কাজ নয় বলে মানসিক চাপ নিতে হয়, সে কথাও জেনেছি তার কাছ থেকে। এতসব চাপ মেনে নিয়ে বাংলাদেশের তারুণ্য ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির দেশ হতে পেরেছে, তা কেবল এই অদম্য তারুণ্যের কৃতিত্বেই।

কাজেই, ভয় কোরো না বন্ধু। বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে!

n লেখক :কথাসাহিত্যিক