শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পুত্রসন্তান কামনা এবং নারী শিক্ষা

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২১, ২১:৫০

এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, অধ্যাপক, উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগ, মালয় বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া; নাজিয়া মনসুর, প্রভাষক, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ডাউফিন (লন্ডন); টেরেসা রান্ডাজজো, প্রভাষক, ভেনিস সিই ফস্কারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাকি ওয়াহাজ, রিডার, অর্থনীতি বিভাগ, কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য

লিঙ্গবৈষম্য ব্যাপকভাবে আলোচিত একটি বিষয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা বহুবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইউনেসকো (UNESCO) সর্বশেষ জিইএম (Global Education Monitoring Report) লিঙ্গ প্রতিবেদনে সম্প্রতি শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ-অসমতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তা হলো—লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জনে লিঙ্গ বৈসাদৃশ্য। বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার বয়সি ৩ কোটি ১০ লাখ মেয়ে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এবং তাদের অর্ধেকই কখনো স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৫ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি তরুণী একটি সম্পূর্ণ বাক্যও পড়তে সক্ষম নন। এর একটি কারণ হলো সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্য। দক্ষিণ এশিয়ায় অধিকাংশ বাবা-মা শিশু জন্মের সময় একটি ছেলেসন্তান প্রত্যাশা করেন। এর প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে।

আমরা সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে Is son preference disappearing from Bangladesh’ শিরোনামে একটি গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সন্তান কামনার বিষয়টি মূল্যায়ন করেছি। এই মূল্যায়নের নিরিখে এই নিবন্ধে ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সন্তান কামনার ভারসাম্যহীনতার সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো দেখা হয়েছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-অসমতা বন্ধে

অগ্রগতির হারের পার্থক্য

দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-অসমতা বন্ধে অসাধারণ অগ্রগতি হলেও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের জন্য শিক্ষাকে বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে ভারতীয় সংসদ শিক্ষার অধিকার আইনটি পাশ করার পর সেখানে ২০১৩ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছিল। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের সাম্প্রতিক অর্জনের বিপরীতে, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র ক্লাসরুমে মেয়েদের উপস্থিতি ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

ভারতে লিঙ্গবৈষম্যের কারণে লক্ষ মেয়ে জনসংখ্যা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়েছে, মূলত কন্যাশিশুদের মধ্যে বেশি মৃত্যুহার এবং লিঙ্গ নির্বাচনি গর্ভপাতের কারণে। বিশ্বে নারীর অতিরিক্ত মৃত্যুহার ভারতে সবচেয়ে বেশি, যার হার প্রতি হাজারে ১৩ দশমিক ৫—পাঁচ । সম্পূর্ণ বিপরীতে, এই সংখ্যা প্রতিবেশী বাংলাদেশে তিনেরও কম। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত শিশুদের আদর্শিক সংখ্যা সেই সব নারীর মধ্যে কম, যাদের প্রাথমিক-পরবর্তী পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে।  এটি কী ব্যাখ্যা করে? আমাদের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি নারীর শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে।

কাঙ্ক্ষিত ও প্রকৃত প্রজননক্ষমতা নির্বাচনের বিশ্লেষণ করার জন্য ২০১৪ সালে প্রজননক্ষমতা আছে এমন ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সি কয়েক হাজার নারীর ওপর একটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা জরিপ চালানো হয়েছিল দেশব্যাপী। সেই ডাটা দিয়ে সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে আমরা দেখিয়েছি যে যদিও ‘পুত্রসন্তান কামনা’ এখনো বিস্তর, তবে বাংলাদেশের নারীর মধ্যে ‘পুত্রসন্তান কামনা’ দিনে দিনে কমছে।

তিন দশক আগে, বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীর জন্য অর্থনৈতিক সুযোগগুলো খুব সীমাবদ্ধ ছিল। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান কম থাকায় নারীশিশু গ্রহণের দিকে অগ্রাধিকার পরিবর্তন করার জন্য নারী শিক্ষা যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে নারীদের জীবন দুটি দিক থেকেই পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র চিরাচরিত পুত্রসন্তান কামনা এবং নারীর নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থানের ফলে নারীশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য পরিবারের উত্সাহ কম দেখায়। এর ফলে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বৃহত্তর লিঙ্গ-অসমতার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়েছিল ভিন্ন পথ। সেখানে প্রজনন অগ্রাধিকার পর্যবেক্ষিত পরিবর্তনটি ঘটার অনেক আগেই সমস্ত আর্থসামাজিক গ্রুপগুলোতে মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে তালিকাভুক্তির ব্যবধানটি বিপরীত হয়েছিল। এর বিপরীতে একই সময়কালে (অর্থাত্, ১৯৯০-এর দশকে) ভারতে পদ্ধতিগত লিঙ্গভিত্তিক শিক্ষা-অসমতা এমনকি পারিবারিক স্তরেও বহাল ছিল।  শ্রমবাজারে পরিবর্তনের ফলেও বাংলাদেশও লাভবান হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ-ভারসাম্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা মাধ্যমিক বিদ্যালয়সম্পন্ন নারীর পাশাপাশি সেই সব নারীর মধ্যে অধিক, যারা নারীর বেতনভিত্তিক কাজের জন্য আরো বেশি সুযোগের ক্ষেত্র থাকা জায়গায় বাস করেছেন; বিশেষত রমরমা তৈরি পোশাক খাত, যা কয়েক মিলিয়ন তরুণ বাংলাদেশি নারীকে কাজের সুযোগ এনে দিয়েছে।

ভারতে ভারসাম্যটির পরিবর্তন

বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা দূর করতে ভারতের সাম্প্রতিক সাফল্য এটি ইঙ্গিত করে যে ভবিষ্যতে এই দেশও প্রজননক্ষেত্রে লিঙ্গ বাছাইয়ের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে পরিবর্তনের পথে যেতে পারে, যা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অর্জিত হয়েছে। তবে বাবা-মায়েদের এখনো শিক্ষাগত বিনিয়োগের বরাদ্দের ক্ষেত্রে মেয়েদের সঙ্গে অসম আচরণ করতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে ভারতের স্কুলে অধ্যয়নরত শিশুদের মধ্যে পরিবারের শিক্ষামূলক ব্যয়গুলোতে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রমাণাদি এটাই স্পষ্ট করে যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের পরিণতি দীর্ঘ মেয়াদে খুবই নেতিবাচক। বাংলাদেশের অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী দশকগুলোতে নারীশিক্ষার প্রসারে নীতিসহায়তা অব্যাহত রাখা উচিত। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে লাখ লাখ মাধ্যমিক স্কুলসম্পন্ন নারী আগামী দশকে শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করবে। তাদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করা একই সঙ্গে জরুরি। তবে এ ধরনের মানববান্ধব সামাজিক বিনিয়োগ এবং নারীশিক্ষার অগ্রগতি ভারতের জনসংখ্যায় লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে কি না, তা এখনো তলিয়ে দেখার বিষয়।

n অনুবাদ : ফয়সাল খান, অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় পরামর্শক (প্রাক্তন), ইউএনডিপি এবং ইউএনসিডিএফ বাংলাদেশ