আসছে ১৫ জুন ‘প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস’। প্রবীণেরা সমাজে প্রতিনিয়ত অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন—এই দিবস তা প্রমাণ করছে। যারা পরিবার, সমাজ তথা এ দেশের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে দিতে জীবন-যৌবন উত্সর্গ করেছেন, আজ তারা যেন পরিবার ও সমাজে মূল্যহীন। আজকের সমাজ ও সভ্যতার মূল কারিগর এই প্রবীণেরাই। তাই তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব। চিকিত্সাবিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে একদিকে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, অন্যদিকে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণ নারী-পুরুষের সংখ্যাও বেড়ে গেছে এবং যাচ্ছে। বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্য প্রায় ১০০ কোটিতে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে এ সংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটি। বিআইডিএসের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ ছিল প্রবীণ জনগোষ্ঠী। ২০০১ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। জনসংখ্যার এই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৫০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর হার হবে ২০ শতাংশ। অর্থাত্, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন হবেন প্রবীণ। প্রবীণ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির এই হার আমাদের জাতীয় জীবনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত? ২০১৯ সালের ১৯ জুন ‘প্রবীণ অধিকার সুরক্ষা :চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেছিলেন, ‘প্রবীণদের জন্য আরো প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা উচিত। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। প্রবীণদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। সরকার প্রবীণদের জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক। তবে সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যমসহ সবার দায়িত্ব সমন্বিতভাবে বিষয়টি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা।’ পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয়ের দেওয়া এই বক্তব্যের দুই বছর ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, কিন্তু প্রবীণদের জন্য সরকারি উদ্যোগে আধুনিক মানসম্পন্ন এ পর্যন্ত কয়টি প্রবীণ নিবাস তৈরি করা হয়েছে? কিংবা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য কার্যকর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ এবং পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ পাশ করা হয়েছে। বিগত আট বছরে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, কর্মে অক্ষমতা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের কল্যাণের জন্য ১৯৮২ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত প্রবীণবিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা গৃহীত হয়েছে। আজ ২০২১ সালে এসেও প্রবীণেরা তাদের সামাজিক মর্যাদা বা স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। ২০১৩ সালে প্রণীত জাতীয় প্রবীণ নীতিমালায় যেসব সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে, বিগত আট বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? নীতিমালায় অনেক কথাই বলা হয়েছে। সব কথা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরছি:
১. প্রবীণ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, ২. প্রবীণদের সমাজের বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান, ৩. জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সম্পদ-মর্যাদা-লিঙ্গনির্বিশেষে রাষ্ট্রে প্রবীণদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা, ৪. সব ধরনের টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড, হাসপাতাল ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ভবনসমূহে ঢালু পথের ব্যবস্থা করা, ৫. তাদের জন্য পরিচিতি কার্ডের ব্যবস্থা, ৬. সব ধরনের যানবাহনে প্রবীণদের জন্য আসন সংরক্ষণ, স্বল্প মূল্যে টিকিট প্রদানের ব্যবস্থা এবং টিকিট সংগ্রহের জন্য আলাদা কাউন্টারের ব্যবস্থা করা; ৭. সমাজ ও পরিবারে ব্যক্তিরা যাতে অবহেলা, অবজ্ঞা, বৈষম্য, নিপীড়নের শিকার না হন, তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা; ৮. পরিবারে প্রবীণ পুরুষ ও নারীদের ন্যায্য সম্পত্তি ভোগের অধিকার নিশ্চিত করা এবং আইনগতভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান; ৯. প্রবীণ ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক পূর্ণভাবে নিরাপত্তা বিধান করা; ১০. জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে হতদরিদ্র প্রবীণদের চিহ্নিত করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; ১১. প্রবীণ, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের আয়বর্ধক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণে সহায়তা করা; ১২. নিয়োগ, আয়বর্ধক কাজের সুযোগ, ক্ষুদ্রঋণ, বাজার ও সম্পদের ওপর প্রবীণদের সমপ্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া রয়েছে পিতামাতার ভরণপোষণ আইন। প্রত্যেক সন্তানকে তাদের পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। তা না করলে কী ধরনের দণ্ড প্রদান করা হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত নীতিমালায় উল্লেখ থাকলেও এ আইন মোটেও কার্যকর হচ্ছে বলে জানা নেই। উপরন্তু বলা যায়, এ আইন সম্পর্কে অধিকাংশই অবগত নন। সন্তানেরা পিতামাতার দেখভাল বা ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করলে প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন হতো না। সরকার দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেছে। করোনার আঘাতে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে এবং বেকার হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে ৮৯ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন করে ৫৭ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হবে। সে জন্য এই বাজেটে বরাদ্দ থাকছে ৩ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। চলতি বছর বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৩টি সামাজিক কর্মসূচি থাকলেও বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হচ্ছে বলে সরকারিভাবে প্রণীত সমীক্ষায় দেখা যায়। তা ছাড়া দেশে একটা বিরাট সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছেন, তারা কীভাবে তাদের দিন গুজরান করছেন তাদের কথা কেউই ভাবে না। পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেকেই সারা জীবনের আয়ের একটি অংশ দিয়ে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। সেখানেও সরকার বিগত দুই বছর থেকে মুনাফার ১০ শতাংশ কেটে রাখছেন।
বর্তমান সরকার প্রবীণবান্ধব সরকার। কাজেই প্রবীণদের কল্যাণে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ বাস্তবায়ন, সঞ্চয়পত্র থেকে কর্তনকৃত মুনাফার কর প্রত্যাহার, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সর্বজনীন পেনশন-সুবিধার ব্যবস্থাসহ আনুসঙ্গিক সুবিধাদি প্রদানের মাধ্যমে প্রবীণদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
n লেখক :সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক