শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়া

আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২১:৩২

প্রায় এক মাস হতে চলল যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার। ‘গড’ নির্দেশিত সামরিক অভিযানের এমন ভরাডুবির নজির যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কি এই প্রথম? সাড়ে চার দশক আগে ভিয়েতনাম থেকে পাততাড়ি গোটানোর সঙ্গে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর তড়িঘড়ি পাততাড়ি গোটানোর তুলনায় একটা ফারাক আছে অবশ্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আর তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ‘ঐশ্বরিক দায়’, দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে ‘বিশ্বের ত্রাতা’ মনে করা যুক্তরাষ্ট্রের দুই ক্ষেত্রেই রণে ভঙ্গ দেওয়ার তাত্পর্য অভিন্ন। বিপদ দেখলে নিজে পিছু হটে বন্ধুকে বন্দুকের নলের সামনে ফেলে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এই তো দুই বছর আগে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দিদের তুর্কি বাহিনীর বলির পাঁঠা করে সটান সটকে পড়েছিল তারা।

তাই সায়গন থেকে মার্কিন নাগরিকদের পড়িমরি সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য কাবুলে হুবহু পুনর্মঞ্চায়ন কি ‘অনিবার্য’ হয়ে ওঠে না? সন্ত্রস্ত ত্রাসিত সাধারণ আফগানদের আমেরিকার বিমানের ওঠার মরিয়া চেষ্টার উত্তরও আরেক দফায় পরিষ্কার হয়ে যায় বিশ্বের সামনে। দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘শান্তির বীজ’ আফগানিস্তানে পুঁতেছে, তা একটুও মাথা তো তোলেইনি, বরং তালেবানই দিনে দিনে মহিরুহ হয়ে উঠেছে। সেই বিষবৃক্ষের তলায় সাধারণ আফগানদের জন্য কোনো ছায়া নেই।

এই চরম ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে পৃথক ফল হয়তো তুলে ধরা যায় (জো বাইডেন তেমন ব্যাখ্যাই দিচ্ছেন), কিন্তু মিত্রের প্রতি অবিশ্বস্ততার যে বিশালকার ‘স্ট্যাচু’ কাবুলে দাঁড় করিয়ে গেল তার দেশ, তা বিশ্বের সব কোণ থেকেই সমভাবে দৃশ্যমান। ‘ইউনাইটেড স্টেটস : দ্য কান্ট্রি হোয়্যার/লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু’—কবি নিকানোর পাররার লেখা কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতাও আদপে ‘স্ট্যাচু’; তাতে হার্দিক স্পন্দন নেই!

এক-এগারোর পর আফগানিস্তানে মিত্র ন্যাটোকে নিয়ে সর্বাত্মক সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে জর্জ বুশের জবানিতে উচ্চারিত হয়েছিল ‘গডের নির্দেশ’। এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তালেবান, আল-কায়েদাসহ যত কিসিমের চরমপন্থি, মৌলবাদী শক্তি আছে, তা ঝাড়েবংশে বিনাশ করা ছিল তাদের প্রথম মনোযোগ। দ্বিতীয়ত, দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, যা বৃহত্তরভাবে বিশ্বশান্তির অংশ। দুটি বিষয়েই তাদের ‘অর্জন’ এখন প্রকাশ্যে, যার সরল তর্জমা, বিশ্বের বুকে সুদীর্ঘকাল ধরে এককভাবে ছড়ি ঘোরানোর দিন ঢলে পড়েছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৮ হাজারের বেশি সেনা খুইয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সে তুলনায় আফগানিস্তানে দুই দশকে আড়াই হাজারের মতো মার্কিন সেনার প্রাণহানি সেভাবে আমলযোগ্য বলা চলে না। কিন্তু আফগানিস্তানে যুগপত্ সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয় তাদের বৈশ্বিক অভিভাবকত্ব, কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব ততটাই মাটিতে মিশাল, তালেবান ঠিক যতটা শক্তভাবে মাটিতে দাঁড়ানোর মওকা পেল। তাই একে কেবল পরাজয় বললেই শেষ হয়ে যায় না, চরমভাবে অপদস্ত হলো যুক্তরাষ্ট্র। এই অপদস্ততার পাশাপাশি বিশ্বাসযোগ্যতাও হারাল তারা ততটাই, যতটা একজন মিত্রের ভরসা নষ্টের জন্য যথেষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল আফগান সরকারকে বাদ দিয়েই। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে এটা পরিষ্কার যে, একটা দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষকে বাদ দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তালেবানের সঙ্গে করা চুক্তি আজকের দিনটাকেই ডাক দিয়েছিল। জো বাইডেন সেই চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে সেনা প্রত্যাহার করে ডাকটাকে বুলন্দ করেছেন। তালেবানের কাবুল দখলের সপ্তাহ দুয়েক আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বৈঠকও ততটাই ইঙ্গিতপূর্ণ। অর্থাত্ খনিজ সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় চীনের জন্য হাতে জাদুর কাঠি পাওয়া। এরই মধ্য তালেবান ও চীন একে অপরের প্রতি হাত বাড়িয়েও দিয়েছে। চীন তার উইঘুর প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে রাখতে তালেবানের সঙ্গে দোস্তালি চাইবে—এটাই কূটনৈতিক সরল অঙ্ক। ধীরে ধীরে পাকিস্তান, ইরানসহ মধ্য এশিয়া জুড়েও আধিপত্য বাড়াবে তারা জোরকদমে। আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের ভূমিকায় বরাবরেই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে ভারত। এসবের মোটা দাগে যোগফল হলো যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতা খর্ব হওয়া এবং চীনের উত্তরোত্তর আধিপত্যবাদের বিকাশের পথ প্রশস্ত হওয়া। কিন্তু এই ফাঁকে রাশিয়াও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপমান কামাই করে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। খবর রটেছে, ভ্লাদিমির পুতিনের একজন খাস দূত নাকি আফগানিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে তালেবানের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছেন। লক্ষণীয়, কাবুলে এখনো রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও তুরস্কের দূতাবাস চালু রয়েছে। অতএব ভূরাজনৈতিক অঙ্কটাও মিলে যায়।

পাকিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া তালেবানের আফগানিস্তানের সীমান্তের বাইরে পা ফেলার লক্ষ্য আছে বলে যদিও প্রতীয়মান হয় না এখনো, কিন্তু তাদের উত্থানে কট্টরপন্থিরা চাঙ্গা হওয়ার, বিশ্ব জুড়েই জিহাদি আন্দোলন-সন্ত্রাস বেগবান হওয়ার আবহ তৈরি হলো। মার খেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া আল-কায়েদা, আইএসসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নতুন আস্তানাও হতে পারে তালেবানের কবজায় থাকা আফগানিস্তান। এমন সমূহ সর্বনাশের দরজা খুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই দরজায় উঁকি দিলে দেখা যাচ্ছে তাদের বিমর্ষ মুখ।

n লেখক : সাংবাদিক