শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কেন এমন উন্মাদনা?

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০১৯, ২১:৪৩

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঘুম থেকে ওঠে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো টেলিভিশন অন করতেই নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের মসজিদে সন্ত্রাসী আক্রমণের খবর স্ক্রলে দেখার পর প্রথমেই মনে আসে ওখানে তো আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম আরো কিছু জানার জন্য। কিন্তু তখনো বিস্তারিত কেউ কিছু বলতে পারছে না। তবে বেলা বাড়তেই সিএনএন বিবিসিসহ বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া ঘটনাস্থলের লাইভ বর্ণনা দিতে থাকে। যে খবর আসতে থাকে তাতে সারা বিশ্বের মানুষ উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার সঙ্গে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, মনে প্রশ্ন আসে এটাও কি সম্ভব। নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপূর্ণ দেশে এমন ঘটনা ঘটবে তা বোধ হয় কেউই ভাবতে পারেনি। এই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণ হলো, বিশ্বব্যাপী আজ যেভাবে জাতিগত এবং আন্তঃধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে তার ভয়ঙ্কর থাবা থেকে পৃথিবীর কোনো প্রান্তরই এখন আর নিরাপদ নয়।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম আক্রমণ হয় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর এবং পাঁচ-ছয় মিনিটের ব্যবধানে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে আরেকটি স্থানে লিনউড মসজিদেও একই রকমের আক্রমণ হয়। দুই মসজিদে আক্রমণকারী কি একই ব্যক্তি নাকি ভিন্ন ব্যক্তি তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দুই স্থান মিলে ওই আক্রমণে চারজন বাংলাদেশিসহ মোট ৫০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো বেশ কিছু। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সদস্যরা। শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য তারা একটা বাসে করে আল নূর মসজিদের প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন পথচারী মহিলা সতর্ক করাতে তারা পথিমধ্যে থেমে যান। আমাদের ক্রিকেট দলের সদস্যরা মাত্র আর চার-পাঁচ মিনিট আগে গেলেই বাংলাদেশের জন্য কত বড় বিপদ হতে পারত তা ভাবতেও পারছি না। অলৌকিকভাবে এ যাত্রায় বোধ হয় আমরা বেঁচে গেলাম। ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটা তার দেশের জন্য সবচাইতে অন্ধকারময় সময়। বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এবং শান্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে নিন্দার ঝড় ওঠেছে। স্বয়ং নিউজিল্যান্ডেরই সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ ব্যাপকভাবে ঘটনাস্থলে এসে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিউজিল্যান্ডের পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আল নূর মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন টারান্ট (২৮) নামের এক যুবক রয়েছে— যিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। ব্রেনটন নিজেই তার লেখা মেনিফেস্টোতে বলেছে, গত প্রায় দুই বছর যাবত্ এই ধরনের একটা আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল এবং আল নূর মসজিদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত সে নেয় তিন মাস আগে। এই সময়ের মধ্যে সে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ সফর করেছে। সে বলেছে, ইউরোপের যেকোনো দেশের চাইতে নিউজিল্যান্ডই তার কাছে অধিকতর সহায়ক মনে হয়েছে যেখানে সে সহজেই আক্রমণ চালাতে পারবে। ঘটনা ঘটে শুক্রবার। কিন্তু তার দুই দিন আগে বুধবার টুইটারে ব্রেনটন রাইফেল এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদির ছবি পোস্ট করে। আক্রমণের এতগুলো আগাম তত্পরতা ও ইঙ্গিত থাকার পরেও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই জানতে পারল না। শুক্রবারে আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসতেও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সময় লেগেছে। নিউজিল্যান্ড বা ক্রাইস্টচার্চ শহর বাংলাদেশ বা ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতির জনপদ নয়, সেখানে এত ট্র্যাফিক জ্যামও নেই। তারপরেও পুলিশের ঘটনাস্থলে আসতে এত সময় লাগল কেন, এ প্রশ্নটিও ওঠেছে সর্বত্র। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে তারা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মানসকাঠামোতে এমন ঘটনার কোনো ধারণাই হয়তো ছিল না। সুতরাং এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মতুষ্টির দেওয়ালটা বোধ হয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনার ফলে আমার কাছে মনে হয়েছে এ ধরনের আকস্মিক ঘটনা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন অনেক দক্ষ।

আল নূর মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন পরিকল্পিতভাবে মাথার হেলমেটে সংযুক্ত ক্যামেরার মাধ্যমে হামলার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে। ভিডিওতে দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, এটা হয়তো হলিউডের কোনো সিনেমার চিত্র বা কোনো ভিডিও গেম শো। ১৭ মিনিট ধরে পরিচালিত এই আক্রমণের মর্মান্তিক ও অমানবিক দৃশ্য সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দেখেছে। ব্রেনটন অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই দৃশ্য সম্প্রচার করেছে— যাতে ইউরোপসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা এটা দেখে উত্সাহিত হয় এবং সর্বত্র একই ধরনের আক্রমণ চালায়। মুসলমানসহ এশিয়া-আফ্রিকার অভিবাসীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়াও এর আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে। আক্রমণের পূর্বে ব্রেনটন ৭৪ পৃষ্ঠার একটি মেনিফেস্টো তৈরি করে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে সে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে লিখেছে। এ জঘন্য আক্রমণের জের ও পরিণতি উপলব্ধি করার জন্য তার ওই মেনিফেস্টোর প্রধান প্রধান পয়েন্টগুলোর ওপর একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন এক নম্বরে সে বলেছে, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশসমূহে শ্বেতাঙ্গদের জায়গা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে অভিবাসীগণ, যাদের জন্মহার অনেক বেশি। দুই. সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শ্বেতাঙ্গদের যথার্থ প্রতিনিধি এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তিন. নরওয়ের গণহত্যাকারী, যে এক আক্রমণে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল অভিবাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের অংশ হিসেবে, সেই নরওয়ের নাগরিক অ্যান্ডারস ব্রেভিককে ব্রেনটন গুরু মনে করে এবং দাবি করে আল নূর মসজিদ আক্রমণের পিছনে ব্রেভিকের আশীর্বাদ আছে। চার. অভিবাসন ও বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্রেনটন খুবই ক্ষুব্ধ এবং সে মনে করে অভিবাসীদের আগ্রাসনে ইউরোপের  শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতি ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। পাঁচ. এ আক্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রেনটন বলেছে, অনুপ্রবেশকারী অভিবাসীদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, আমাদের মাতৃভূমিতে কখনো তাদের জায়গা হবে না এবং একজন শ্বেতাঙ্গ বেঁচে থাকতেও আমাদের মাতৃভূমিকে দখল করতে দেওয়া হবে না। ছয়. ২০১৭ সালে সুইডেনের স্টকহোমে ইসলামিস্ট জঙ্গি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ১১ বছর বয়সী ইবা অকারল্যান্ড নামক যে প্রতিবন্ধী মেয়েটি নিহত হয় তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্রেনটন শুক্রবারে আল নূর মসজিদে হামলা করেছে বলে উল্লেখ করে। সাত. কিছু দিন আগে ব্রেনটন ফ্রান্স ভ্রমণ করে এবং সেখানকার পরিস্থিতি দেখে তার মনে হয়েছে ফ্রান্সের প্রতিটি শহর-বন্দর এখন অভিবাসী অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে গেছে। আট. এ বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের জন্য ব্রেনটনের কোনো অনুশোচনা নেই। বরং শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদের শ্রেষ্ঠত্বকে রক্ষা করার জন্য অভিবাসন ও বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থানকে জানান দেওয়ার জন্যেই এ আক্রমণ।

উপর্যুক্ত ক্রম এক থেকে আট পর্যন্ত উল্লিখিত বক্তব্যগুলো ব্রেনটনের। ক্রাইস্টচার্চের আক্রমণের পর সামাজিক মাধ্যমে বেনামে ব্রেনটনকে হিরো হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে— ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সে এ কাজ করতে পেরেছে। সুতরাং এ অমানবিক আক্রমণের জের ও পরিণতিতে বৈশ্বিক জননিরাপত্তা পরিস্থিতি আগামীতে কোন দিকে যাবে তা নিয়ে বিশ্বের সকল শুভবুদ্ধির মানুষ শঙ্কিত। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত একটা প্রতিক্রিয়ার কথা আমরা সকলে জানি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর বিশ্বের পরিস্থিতি কত ভয়ঙ্কর এক ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ধাবিত হয়েছে তা আমরা সকলেই দেখেছি, যার  অশুভ থাবা থেকে বিশ্ব এখনো মুক্ত হতে পারেনি। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের এ ঘটনায় ইসলামিস্ট উগ্রবাদী জঙ্গিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা তো অনেকেই ভাবতেই পারছেন না। আল-কায়েদা, আইএস এখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে আল শাবাব ও বোকোহারামের মতো জঙ্গিদের আক্রমণে। সুতরাং এ আঘাত ও পাল্টা আঘাতের শেষ কোথায়। এর দ্বারা মানবতা, সভ্যতা কোনোটারই উপকার হয় না এবং এর মাধ্যমে কোনো সমস্যারই যে সমাধান হবে না সেটি তো জলের মতো পরিষ্কার, সবাই বোঝেন। তারপরেও কেন এমন উন্মাদনা। তারপরেও কেন একশ্রেণির মানুষ এ উগ্রবাদের দিকে যাচ্ছে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ বিশ্বের শান্তিবাদী মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে। ব্রেনটন যেভাবে তার মেনিফোস্টো ছড়িয়ে দিয়েছে এবং সহিংসতার সচিত্র ভিডিও সম্প্রচার করেছে তাতে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসীরা উত্সাহিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।

আমেরিকা ফার্স্ট, ব্রিটেন ফার্স্ট ইত্যাদি যেসব স্লোগান ওঠেছে তা এ ধরনের উগ্রবাদকে ক্রমশই উত্সাহিত করছে। ইউরোপে ক্রমেই উগ্র ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান ঘটছে। এগুলো আশঙ্কার দিক। তবে এত কিছুর পরেও আশাবাদের দিক এখনো অনেক বড় ও বিস্তৃত। তাই এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর পর দেখেছি, ফ্রান্সসহ সারা ইউরোপের সকল বর্ণের ও ধর্মের মানুষ ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে। বিশ্ব সংস্থাসমূহ ও নেতৃবৃন্দকে উপলব্ধি করতে হবে সংকীর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, আধিপত্যবাদের কৌশল এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যত বৃদ্ধি পাবে, ততই প্রতিটি সমাজের ভেতর থেকে ব্রেনটনের মতো উগ্রবাদীর জন্ম হবে। তবে আশার কথা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুভ শক্তি, শান্তি ও মানবতার পক্ষে। তাই শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ড উগ্রবাদের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত হলেও অশুভ শক্তি ও মানবতাবিরোধী উগ্রবাদ কখনোই সফল হবে না।

n লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক