বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সুদানে কেন এই সামরিক অভ্যুত্থান?

আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৩৩

আবার যেন এক ‘গণতন্ত্রের বসন্ত’ শুরু হয়েছে আরব আফ্রিকায়। এই সেদিন গণবিক্ষোভের মুখে বিদায় নিলেন আলজেরিয়ার স্বৈরশাসক বুত্ ফালেকা। এবার সুদানে পরিবর্ধিত হয়েছে নব আরব বসন্ত। ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ওমর আল বশির ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিনি গত ৩০ বছর ধরে দেশটি শাসন করছিলেন। বশিরের বিশ্বস্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী আওয়াদ ইবনে আওফ বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ক্রমাগত গণবিক্ষোভে বিধ্বস্ত বশির প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলে প্ররোচিত করেন। সেখানে তেল ও রুটির দাম বৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘদিন গণআন্দোলন চলছিল। গত ১১ এপ্রিল সেনাবাহিনী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এক মাসের জন্য কারফিউ বলবত্ করা হয়েছে। প্রাথমিক ঘোষণায় বলা হয়, আগামী দু’বছর ক্ষমতা সামরিক কাউন্সিলের হাতে থাকবে এবং আওফ অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, আগামী দু’বছরের মধ্যে দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনা হবে। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা হবে তার দায়িত্ব। প্রতিরক্ষা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে আওফ সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন।

বশিরের তিন দশকের শাসনামলে বিভক্ত হয়েছে দেশ। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। উত্তর বনাম দক্ষিণ গৃহযুদ্ধের অবসানের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় আসা বশির অবশেষে দেশটিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেন। দক্ষিণ সুদান যেহেতু খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন ওমর আল বশির। এরপরও সুদানে শান্তি ফিরে আসেনি। তেল ও রুটি তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি গণবিক্ষোভের সূচনা করে। ওমর আল বশিরের ইসলামি কর্মসূচি এবং স্বকীয় ধারার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ কখনোই পাশ্চাত্যের অনুমোদন পায়নি। তার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দুটো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ২০১০ ও ২০১৫ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হন। অবশ্য নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরোধীদের আপত্তি ছিল সব সময়।

সামরিক অভ্যুত্থানের রেশ কাটতে না কাটতেই জনগণের বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়। কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাজধানী খার্তুমে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের কাছে বিক্ষোভ করে লাখো লাখো মানুষ। তারা বলছেন নবগঠিত সামরিক সরকার বশির প্রশাসনের সম্প্রসারিত অংশ মাত্র। তারা অতি দ্রুত বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। বিক্ষোভকারীরা সামরিক শাসকদের কোনো কথাই শুনতে নারাজ। ফলে আন্দোলনকারী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আরেকটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ব্রিটেন। বিক্ষোভ দীর্ঘস্থায়ী করতে সেনা সদর দপ্তরের কাছে বড় বড় তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। বিভিন্ন ধরনের মানুষ খাদ্য পানিসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছেন বিক্ষোভকারীদের। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সুদানিজ প্রফেশনাল এসোসিয়েশনের নেতা সারা আবদুল আজিজ বলেন, ‘এটা আগের সরকারেরই ধারাবাহিকতা। কেবল মুখোশের পরিবর্তন হয়েছে। সামরিক কাউন্সিলের পিছনে কারা কলকাঠি নাড়ছে তা অস্পষ্ট। আমরা আমূল পরিবর্তন চাই।’

সামরিক বাহিনী জনগণের এই আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞগণ। সামরিক বাহিনীর বার্তায় নরম সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণবিক্ষোভের মুখে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলেও এ অভ্যুত্থানকে পাশ্চাত্যমুখী বলে অভিহিত করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। বার্তা সংস্থা আনাদোলু’র এক রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীননীতি অনুসরণ করায় এই সেনা অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হলেন। বশির অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পশ্চিমা ধারা অনুসরণ করতেন না। তাদের বিশ্লেষণে সামরিক অভ্যুত্থানটি ঘটেছে পশ্চিমা স্বার্থে। এতে কয়েকটি রক্ষণশীল আরব দেশের সমর্থন রয়েছে। এ দেশগুলো সুদানের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কব্জা করতে চায়। সেখানে স্বর্ণখনি রয়েছে। উল্লেখ্য যে, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা ইতোমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছে। পাশ্চাত্যবিরোধী বলে পরিচিত বৈশ্বিক শক্তি রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও ইরান স্ব স্ব ভাষায় অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছে। বশিরকে পদচ্যুত করাতে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল সুদানের বিরাজমান পরিস্থিতির কোনো সঠিক জবাব নয়। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ বরিস ডগলোভ বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো ওমর আল বশিরকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। এসব দেশ সুদানের সম্পদ দখলের চেষ্টা করছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে এক সময়ের আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশটিকে বিভক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা দক্ষিণ সুদানে সম্পদ আহরণ করতে শুরু করেছে। এখন সুদানের পালা। বরিস আরও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, দেশটির পশ্চিমামুখী সেনাবাহিনী শীঘ্রই হয়তো খনিজ সম্পদ আহরণে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে অগ্রাধিকার দেবে। তিনি বলেন, যদিও বশির একজন বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন তবুও তিনি পশ্চিমা চাপ সত্ত্বেও আপস করেননি। একই লক্ষ্যে পশ্চিমারা বহুবার দেশটির উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে সামগ্রিক অবস্থার অবনতি ঘটে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তারা এসব কিছু করছিল।

এদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভয়েচ অব আফ্রিকা’র রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এনজিন ওজের বলেন, বশিরের পাশ্চাত্যবিরোধী ভূমিকার কারণেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। গত কয়েক বছরে সুদান সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তন করেছে। বশির রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং সুদানে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করার অনুমতি দিয়েছেন। এছাড়া তিনি তুরস্ককে সুদানের সমুদ্র বন্দর সাওকিনে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করার অনুমতি দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সাউকিন লোহিত সাগর পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর। এ পথ দিয়েই উপসাগরীয় অঞ্চলে তেল ট্যাংকারগুলো চলাচল করে। এই নৌপথের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরব জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ওজের আরো অভিযোগ করেন, আমিরাতের গোয়েন্দা সংস্থা গত দু’বছর ধরে বশিরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করতে দেশটির বিরোধী দলগুলোকে সহায়তা করেছে। ওজেরের বক্তব্যে প্রমাণ মেলে এভাবে যে, মার্কিন সমর্থিত মিসরের সামরিক সরকার ইতিমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এদিকে সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনকারী পাশ্চাত্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কয়েক দশকের বিভেদ ভুলে একটি শক্ত বশিরবিরোধী জোট গঠন করেছে। ত্রিদলীয় জোটটি অ্যালায়েন্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড চেইঞ্জ বলে পরিচিত।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সামরিক সরকার বশির সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বশির এবং তার মন্ত্রীদের বিচার করা হতে পারে। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে দেশটির দারফুরে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সুদানের সামরিক সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এখান তার ভাগ্যে কী ঘটবে তা পরিষ্কার নয়। তবে সামরিক সরকার জানিয়েছে, তারা বশিরকে আইসিসির কাছে হস্তান্তর করবে না। প্রয়োজনে সুদানেই তার বিচারের জন্য আদালত গঠন করা হতে পারে। ইতিমধ্যে তাকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে জেলে প্রেরণ করা হয়েছে। জনগণ সেনাসদর দপ্তরের সম্মুখে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। তাদের দাবি আদায় অর্থাত্ একটি বেসরকারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে নেতৃবৃন্দ।  যে সমস্ত আরব দেশে চির অস্থিরতা রয়েছে সুদান তাদের একটি। ১৯৫৬ সালে সুদান ব্রিটেন ও মিশরের যৌথ কবল থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত হয়। তখনো উত্তর-দক্ষিণের সংঘাত সংঘর্ষ চলছিল। ১৯৬৯ সালে সেনাপ্রধান জাফর আল নিমেরি ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭২ সালে সেখানে গৃহযুদ্ধের আপাত সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮০র দশকে অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়। দুর্ভিক্ষ, অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দেশটিকে গ্রাস করে। দক্ষিণ সুদানে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল ওমর হাসান আহমেদ আল বাশার ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য ইসলামপন্থি বশিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও মৌলবাদকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তোলে। ১৯৯৬ সালে গৃহীত নির্বাচনে বশির বিপুল বিজয় লাভ করে। ২০০৪ সালে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বশির প্রকারান্তরে দক্ষিণের স্বাধীনতা মেনে নেন। তা সত্ত্বেও দারফুরে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ড ছিল কালোদের বিরুদ্ধে সাদা আরবদের। সুদানের জনসংখ্যার ৭০ ভাগ সুন্নি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সাদা-কালোর সংঘাত একটি স্থায়ী সমস্যা। সেখানে ৫২% কালো। আর আরব সাদারা হচ্ছে ৩৯%। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী রয়েছে সেখানে। সুতরাং বহু দল, মত ও গোত্রে বিভক্ত সুদানে জাতীয় ঐক্য একটি কঠিন কল্পনা। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে এসব বহুমাত্রিক সমস্যা ক্রিয়াশীল থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

n লেখক :অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়