বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পয়লা বৈশাখের অর্থনীতি

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৫০

কেবলই পয়লা বৈশাখ পেরিয়ে এসেছি আমরা। পুরনো জরা ও গ্লানি ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে সবাই। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে চলেছে নানা উত্সবের আয়োজন। বিভিন্ন স্থানে বসেছে বৈশাখী মেলা। এর শেকড় মূলত গ্রামে। অধুনা তা হয়ে উঠেছে অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। এখন গ্রামে আর শহরে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে বৈশাখী আমেজ। তার প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ তথা দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপর।

বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। এর গোড়াপত্তন হয় ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দে। এর আগে হিজরি ক্যালেন্ডার ধরে পরিচালিত হতো রাজকর্ম। চন্দ্র সন অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো কৃষকদের কাছ থেকে। কিন্তু সৌরবর্ষের তুলনায় চন্দ্রবর্ষ ১০-১১ দিন কম থাকায় খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষকদের জটিলতার মধ্যে পড়তে হতো। তাছাড়া কৃষক বিভিন্ন ফসলের চাষ করতো ঋতু অনুযায়ী। ফসল তোলার পরই খাজনা নেয়ার ছিলো প্রকৃষ্ট  সময়। সম্রাট আকবর তাই প্রবর্তন করেন ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। অতএব বাংলা সন প্রচলনের শুরুটাই হয়েছিল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গ্রামের কৃষক ও জমির খাজনা।

বাংলা নববর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হালখাতা। একসময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক কালে হালখাতার প্রভাব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিধি প্রসারিত হওয়ার ফলে বাকির খাতায় স্থিতি অনেকটা কমে গেছে। তাতে আকর্ষণ হারাচ্ছে হালখাতার অনুষ্ঠান। 

বৈশাখে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে প্রয়োজনীয় খাবার মজুদ থাকে। আনন্দ উত্সবের জন্য প্রস্তুত থাকে সবাই। সব বয়সের মানুষ মুখিয়ে থাকে বৈশাখী মেলার জন্য। এসময় বটতলা ও গ্রামীণ হাটকে সাজানো হয় নানান রঙে। মেলায় আসে তাঁতে বোনা পোশাক, মাটির হাঁড়িপাতিল, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী। বাচ্চাদের খেলনা, কাঠের ও বেতের দ্রব্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র। তাছাড়া যাত্রা, পালাগান, জারিগান, কবিগান, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ও বায়োস্কোপসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান মুখর করে রাখে পয়লা বৈশাখের গ্রামীণ পরিবেশ। স্থানবিশেষে আয়োজন করা হয় গম্ভীরা গান, বলী ও লাঠি খেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য ও জলকেলি খেলা। পাহাড়ি পল্লিগুলো সাজে বর্ণিল উত্সবে। এদিনে নিমন্ত্রণ জানানো হয় মেয়ের জামাই, দোস্ত, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের। পিঠে, পুলি, পায়েস ও নানান রকম মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় তাদের। বাচ্চাদের বখশিশ দেয়া হয় মেলায় খাওয়ার জন্য। তাদের মাঝে বিতরণ করা হয় চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, মঠ ও তিল্লাই। এসবের আয়োজন করতে গিয়ে পয়লা বৈশাখের কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয় প্রস্তুতি। তাতে কাজের পরিধি বাড়ে। নতুন কর্মসংস্থান হয়। আর্থিক লেনদেন ও কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রাণ সঞ্চার হয় প্রতিবছরের বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে।

বাংলা নববর্ষের আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে সারাদেশে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ কী দাঁড়ায় সে সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক সমীক্ষা এ পর্যন্ত হয়নি। তবে অনুমান করা যাচ্ছে যে এর সার্বিক পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। মুসলমানদের দুই ঈদে, হিন্দুদের পূজায়, খ্রিস্টানদের বড়দিনে কিংবা বৌদ্ধ পূর্ণিমায় বাজারে কেনাকাটা বাড়ে। কিন্তু বাংলা নববর্ষ একটি অসাম্প্রদায়িক উত্সব। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এটা সকলের মেলবন্ধন। তাই এই উত্সবে কেনাকাটার ধুম পড়ে। সারাবছর যে কেনাকাটা হয় তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ হয় বাংলা নববর্ষে। এ উত্সবে দেশি পণ্যের চাহিদাই বেশি। ফুটপাত থেকে শুরু করে নামিদামি শপিংমল পর্যন্ত সর্বত্রই কেনাকাটার ব্যস্ততা। এ সময় সরকারি কর্মচারীদের বোনাস দিয়েছে সরকার। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বোনাস দিয়েছে তাদের কর্মচারীদের জন্য। ফলে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে। তাতে কার্যকর চাহিদা বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের। সরবরাহও বেড়েছে এর বিপরীতে। ফুল, মিষ্টি, তাঁত বোনা কাপড়, খেলনা ও বিভিন্ন কারুকাজমণ্ডিত উপহারে বাজার সয়লাব। এরূপ কেনাকাটায় চাঙ্গা হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতার এটি একটি ইতিবাচক দিক। 

বর্ষবরণ উপলক্ষে বাজারে বিভিন্ন ডিজাইনের নতুন পোশাকের সমাহার ঘটে। তরুণীরা পরে লালপেড়ে সাদা শাড়ি আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। এবারের বৈশাখী অনুষ্ঠানে নতুন মাত্রার যোগ করেছে ছেলেদের জন্য বাহারি লুঙ্গি এবং মেয়েদের জন্য হাইব্রিড নামক লাল সাদা সংমিশ্রণে অপরূপ সৌন্দর্যের শাড়ি। এ শিল্পে শুধু পুরুষ নয়, গ্রামের মহিলারাও শ্রম দিয়েছেন লুঙ্গি ও শাড়ি বুননের কাজে। এ বছর একটি হাইব্রিড শাড়ির সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে। তাতে  একজন তাঁত শ্রমিক পেয়েছেন সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা মজুরি। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি আর পাবনার লুঙ্গি খুবই গুণ ও মানসম্পন্ন। এর খ্যাতি আছে সারা দেশজুড়ে। তবে গতবছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বেশি। তবু বিক্রি হয়েছে প্রচুর। দেশের প্রায় প্রতিটি বাজারেই ক্রেতাদের ভিড় দেখা  গেছে। কারণ এবার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো।

পয়লা বৈশাখের উত্সব এখন গ্রাম ছাড়িয়ে নগর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। নগর জীবনে এর জৌলুস অনেক বেশি। আল্পনা আঁকা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বিশালাকার চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। তাছাড়া পথের অলিতে গলিতে পসরা সাজিয়ে বসেছে নানান ধরনের মৃিশল্প। রমনা বটমূলে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বর্ষবরণ সংগীত। নানান রঙের ফুলে ও মালায় ভরে গেছে শহর। এরও একটা অর্থনীতি আছে। বছরের পর বছর এর পরিধি বাড়ছে। তার ছোঁয়া গ্রামেও লাগছে।

শহরে প্রচলিত পান্তা-ইলিশের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনে নববর্ষ উদযাপনের কোনো মিল আছে বলে মনে হয় না। নববর্ষে গ্রামের মানুষ শখ করে পান্তা খায় না। ইলিশ মাছ অনেকে চোখেও দেখে না। এটি কেবলই শহুরে জীবনে নতুন সংযোজন। যার ফলে চৈত্র-সংক্রান্তির আগে থেকেই দাম বেড়ে যায় ইলিশের। বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে ভোলার মেঘনা তেঁতুলিয়ায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকারে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত জেলেরা। খাদ্য তালিকায় পান্তা-ইলিশের অকারণ অন্তর্ভুক্তি ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের এই বেপরোয়া মনোভাবের জন্য দায়ী। এর অবসান হওয়া উচিত।

পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উত্সব। এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সর্বজনীন লোক উত্সবের দিন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের দিন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বর্তমান নগরজীবনে বৈশাখী উত্সবের আয়োজনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে লক্ষ রাখতে হবে যেন পয়লা বৈশাখের চিরায়ত মাধুর্য ও স্বকীয়তা না হারায়।

n লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ