শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আমরা

আপডেট : ১৮ মে ২০১৯, ২১:৫৮

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুটির একশ’ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের ১৪ কোটি মানুষ বসবাস করে যা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমার টেকনিক প্লেটের মাঝে আবদ্ধ। ফলে এই প্লেটগুলোর নাড়াচাড়ার ফলে আমাদের দেশে মাঝে-মাঝেই ভূকম্পন অনুভূত হয়। টেকনিক প্লেটের অবস্থানের কারণে আমাদের উত্তর ও পূর্বে দুটো বর্ডার বা ভূ-চ্যুতি রয়েছে যা বাংলাদেশে সংঘটিত অধিকাংশ ভূমিকম্পের কারণ। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে আরো পাঁচটি সক্রিয় চ্যুতি বিদ্যমান যা যেকোনো সময় মাঝারি থেকে বড়মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। মোটামুটি প্রায় প্রতি একশ’ বছর পরপর এই অঞ্চলে বড় বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে।  ১৯১৮ সালে সর্বশেষ এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে। এরপর প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেছে। তাই বলা যায় আমরা হয়তো আরো একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশের নিচে জমে ওঠা টেকনিক প্লেটে চাপ জমে উঠেছে বিগত প্রায় ৪০০ বছর ধরে। এই চাপ যখন মুক্ত হবে তখন দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকার পাশে মধুপুরকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন এলাকা বলে মনে করা হয়। এছাড়া সিলেট এবং চট্টগ্রামও ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে ‘আরবান বিল্ডিং সেফটি প্রজেক্ট’ ও ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট’-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ ভবনই বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়নি। যার কারণে ঢাকায় ৭/৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভবনের মধ্যে ৭০ হাজার ভবন ধসে পড়বে। ফলে সেখানে কয়েক কোটি টন কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ তৈরি হবে। বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন এলাকা-ভিত্তিক মানচিত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা  ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে, ৪১% এলাকা মধ্যম ঝুঁকিতে এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভূমিকম্পের ফলে আমাদের সব থেকে বেশি যে ক্ষতিটি হবে সেটি হলো সস্তা নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি অপরিকল্পিত ভবনসহ ভারী শিল্প। বিদ্যুত্ কেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেখানে বিদ্যুতের তার পড়ে নানা ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। সব থেকে ভয়ের এবং চিন্তার বিষয়টি হলো ঢাকা শহরে গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ভূকম্পের ফলে গ্যাস লাইন ফেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এক কথায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই ধারণা করা হয়, ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যত লোক মারা যাবে তার থেকে বেশি মারা যাবে আগুনে পুড়ে এবং বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে।

তাই আমাদের এখন থেকেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় ভূমিকম্পের ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নপর্যায় রাখা এবং ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ভূমিকম্পের সময় ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি  না করে মাথা নিচু করে বসে হাত দিয়ে ঢেকে ফেলতে হবে। যে-কোনো বৈদ্যুতিক জিনিস বা লিফট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জাতিসংঘের তৈরি ভূকম্পনজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এটি প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা শুধু একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও টেকসই নগর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষতির মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারি। এর জন্য সবার আগে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।

n লেখক:শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়