শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মূর্তিটি ভাঙল কে?

আপডেট : ২০ মে ২০১৯, ২২:০১

ভারতের লোকসভার ভোট ঘিরে রাজনৈতিক হিংসার ‘বলি’ হলেন খোদ বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টাও। জন্মদ্বিশতবর্ষের মাস চারেক আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হলো তারই নামাঙ্কিত কলেজের বিধান সরণী ক্যাম্পাসে। ১৪ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যার ঐ কলঙ্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী রইলো গোটা বাংলা।

এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরেও সব মহলে প্রশ্ন একটাই। কারা ভাঙলো বিদ্যাসাগরের মূর্তি? ঘটনার পর থেকেই যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ গোটা তৃণমূল শিবির গগনবিদারী কলরব উঠেছে, তাতে সকলের মনেই দেখা দিয়েছে একটাই কথা— এ তো চোরের মায়ের বড় গলা। তৃণমূল শিবির থেকে এই ঘটনার জন্য বিজেপিকে দায়ী করা হলেও সমস্ত রকম পারিপার্শ্বিক তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে। ঐ সব কথার ওপর ভিত্তি করে এমন সন্দেহই প্রবল হয়ে ওঠে যাতে বলা হয়, বিদ্যাসাগরের ঘাতক তৃণমূলই হওয়ার কথা। সপ্তম দফার ভোটের আগে কলকাতাসহ আশপাশের সংশ্লিষ্ট নয়টি লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় নিজেদের পক্ষে নতুন করে একটা রাজনৈতিক ধামাকা বাধানোর উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিতভাবে গতকাল তৃণমূল কলেজ স্কোয়ার থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর কলেজ পর্যন্ত এই এলাকায় বড় রকমের হাঙ্গামা বাধানোর জন্য পূর্ব পরিকল্পনা করে রাখে বলে অনেকের অভিযোগ।  অমিত শাহের রোড শো’তে ব্যাপক জনসমাগম হওয়ার কথা আগেই আঁচ পেয়েছিল তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তাই প্রথমে নানা বাহানায় অমিত শাহের রোড শো বাতিল করার চেষ্টা করা হয় পুলিশি অনুমতির বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে; কিন্তু পুলিশের আপত্তিতে রুট বদল করে শেষ পর্যন্ত যখন ধর্মতলা থেকে বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতির রোড শো শুরু হয়, তখনই তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে খবর আসে অমিত শাহের রোড শোয়ে দেদার লোক হচ্ছে। তখনই তত্পর হয়ে ওঠে তৃণমূলের সমর্থকেরা। উদ্দেশ্য ছিল নাকি বড় রকমের হাঙ্গামা বাধিয়ে তার দায় চাপানো বিজেপির ঘাড়ে। আর এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই গর্দান যায় বিদ্যাসাগরের।

এই ঘটনা নিয়ে নিরপেক্ষ মহলের কাছে প্রথম যে প্রশ্নটি এসেছে তা হলো, সকলেই দেখেছেন ঐ সময় বিদ্যাসাগর কলেজের গেট ছিল বন্ধ। তালা দেওয়া। কলেজের ভিতরে ছিল তৃণমূলের সমর্থকরা। এই অবস্থায় কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল অমিত শাহের রোড শো। বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি ছিল কলেজের ভিতরে। তাহলে প্রশ্ন, বন্ধ থাকা গেটের বাইরে দিয়ে যাওয়া মিছিলের বিজেপি সমর্থকরা কীভাবে বন্ধ গেটের ভেতরে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার সুযোগ পেল? শুধু মূর্তি ভাঙা নয়, ঘণ্টা তিনেক যাবত্ দীর্ঘ সময় ধরে কলেজ স্ট্রিট এলাকায় যে সব ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে তাতে তৃণমূল না বিজেপি কারা হাঙ্গামায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল তার তদন্তের জন্য নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এই দাবি করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছেও। দাবি তোলা হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের কাছেও। তাদের বক্তব্য সংশ্লিষ্ট ঐ এলাকার গোটা রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে আছে সিসি ক্যামেরা। সেই সব ক্যামেরার ফুটেজ অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের হেফাজতে নিয়ে সেগুলোকে খতিয়ে দেখা হোক। পরে সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্য মিশ্র, প্রকাশ কারাতসহ বামপন্থিদের যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের হয়, সেখানেও একই দাবি তোলা হয়েছে।

বিজেপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তৃণমূলই এই হিংসা ছড়িয়েছে। রোড শোয়ে সকাল থেকেই বাধা আসছিল। শোভাযাত্রার আগে পুলিশের সামনেই বিজেপির পতাকা ছেঁড়া হয়। বিদ্যাসাগরের মূর্তি যে ঘরে ছিল, তার চাবি বিজেপি সমর্থকদের কাছে ছিল না। এদিকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে গতকালের ঘটনা জানতে চায় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ। দিল্লি থেকে অমিত শাহও একই দাবি করে বলেন, ভোট ব্যাংকের স্বার্থে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে তৃণমূলই। বিজেপির সমর্থকরা কী করে বন্ধ ঘরের ভিতরে গিয়ে মূর্তি ভাঙবে? তৃণমূলের সমর্থকরাই তো ভিতরে ছিল! তাদের এড়িয়ে বিজেপির কর্মী সমর্থকরা ঢুকতে পারলেন কী করে? 

কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে সন্ধ্যায় প্রথম যে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতে বলা হয়— বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলের কর্মীরাই তাণ্ডব চালিয়েছে; কিন্তু রাতে বিদ্যাসাগর কলেজে হাজির হয়ে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, কলকাতা পুলিশের ঐ বিবৃতি ‘ফেক’। ঐ বিবৃতিতে পুলিশ জানিয়েছিল, ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভুয়া বিবৃতিতে গ্রেফতারির সংখ্যা কীভাবে লেখা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ মহলেই।

স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক নেতানেত্রী থেকে শুরু করে বিদ্বজ্জন ও ছাত্রছাত্রীরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঐ ঘটনার নিন্দায় মুখর হয়েছেন। ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা নাগাদ। অমিত শাহের রোড শো তখন বিধান সরণী ধরে এগোচ্ছে সিমলা স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির উদ্দেশে। তার মিনিট পনেরো-কুড়ি আগইে অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে মিছিলের বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থকদের এক প্রস্থ সংঘর্ষ হয়ে গিয়েছে। অমিতের কনভয় যখন বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে, তখনো বোঝা যায়নি কী হতে চলেছে। কলেজের মূল ফটক ভেজানো ছিল। কনভয়ের চার নম্বর গাড়িতে ছিলেন অমিত। কলেজ থেকে ইটবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অমিতের গাড়ির আশপাশ থেকে উত্তেজিত বিজেপি কর্মীদের বিদ্যাসাগর কলেজের নিউ ক্যাম্পাসের গেটের দিকে ধেয়ে যেতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে সংবাদমাধ্যম পৌঁছে দেখে মূল ফটকের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি। ঐ কলেজেরই জীববিদ্যার শিক্ষিকা মীনাক্ষী মজুমদার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছোটবেলায় ওর ছবিতে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যেতাম। আর আজ আমাদেরই কলেজে আমার চোখের সামনে ওর মূর্তি ভেঙে ফেলা হলো। আমি কিছুই করতে পারলাম না। বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন, বিজেপির কেউ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙেনি। তৃণমূলই তা ভেঙে আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।

সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, তৃণমূল ও বিজেপি এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে তীব্র মেরুকরণের রাজনীতি করে করে মানুষকে ভাগ করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব বামপন্থিদেরই নিতে হবে। রাজ্যের সর্বত্র ধিক্কার মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির হন। সেখানেই সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই ঘটনার গণতান্ত্রিক বদলা নেওয়া হবে। ওরা বাংলার হেরিটেজ, বাংলার ঐতিহ্যের গায়ে হাত দিয়েছে।

প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, মিছিলে ঢিল ছুড়ে প্ররোচনা দিয়ে বিজেপিকে নিজের চরিত্র পরস্ফুিট করার সুযোগ দেওয়া হলো। কলকাতায় যে গুণ্ডামি হলো, সেই পাপের দায় বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়কেই নিতে হবে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেছেন, বাংলার রাজনীতিতে এটা একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি সযত্নে আগলে রেখেছেন ঝড়খন্ডের জামতাড়া, কারমার্টারের বাসিন্দারা। আর খোদ কলকাতায় তারই নামাঙ্কিত কলেজে রক্ষা করা গেল না বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি। এই ঘটনায় ক্রোধে, হতাশায় রীতিমতো ফুটছে কারমার্টার। স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করছেন, বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের মূর্তি ভেঙে আসলে আত্মহননের পথই বেছে নেওয়া হলো।

স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতেই কারমার্টারে একটি বাগানসহ বাড়ি কিনেছিলেন বিদ্যাসাগর। পরে স্কুলও খোলেন। পরে সেই বাড়ি হস্তান্তর হয়ে চলে যায় কলকাতার মল্লিক পরিবারের হাতে। বিহার বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই বাড়িটি কিনে নিয়েছিল ১৯৭২ সালে। সেই থেকেই কারমার্টারের বিদ্যাসাগরের বাড়ি ‘নন্দনকানন’-এর দেখাশোনা করে স্থানীয় নন্দনকানন পরিচালন সমিতি। শুধু জামতাড়া বা কারমার্টারই বাড়িটি দেখভাল করতে রাঁচি, জামশেদপুর, গিরিডি থেকেও বারবার ছুটে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সবস্তরেই বইছে নিন্দার বান। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তাদের নিন্দা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে বাংলার প্রগতিশীলতার ঐতিহ্যকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসুরায় চৌধুরী জানান, রাজ্যের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একযোগে ঐ ঘটনার নিন্দা করেছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, বারাসত রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসব চৌধুরীরা।

ফেসবুক, ট্যুইটার হোয়্যাসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়েছে প্রাক্তন শিক্ষকসহ গোটা দেশের মানুষ। ফেসবুকে এখন ‘আমি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র’ লিখে সার্চ দিলেই উঠে আসছে  এক এক করে ক্ষোভ-বার্তা।

n লেখক : পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ সাংবাদিক