শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ড্রোন প্রযুক্তি :নিরাপত্তাগত হুমকি ও বিদ্যমান আইন

আপডেট : ১০ জুন ২০১৯, ২১:৫৬

বিশ্বে ড্রোন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয় মূলত সামরিক বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজনে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে, যুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমনে এই ড্রোন বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত কার্যকারী প্রযুক্তি। ড্রোন শত্রুর বিরুদ্ধে ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হয়, আবার সন্ত্রাসীরাও এটি ব্যবহার করে। ড্রোন এখন বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, এমনকি বিনোদনের জন্যও ব্যবহূত হচ্ছে। ড্রোনের বহুমুখী ব্যবহারের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তাই নিরাপত্তার জন্য ড্রোন প্রযুক্তির সঙ্গে এন্টি-ড্রোন প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে সীমিত আকারে ড্রোন ব্যবহার হয় এবং পাশাপাশি বেসামরিক পরিমণ্ডলেও এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ড্রোন এখন বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বড় পণ্য। শুধু আমেরিকাতে বছরে প্রায় ২০ লাখ ড্রোন বিক্রি হয়।

ইংরেজি শব্দ ড্রোন (Drone)। এটি একটি রেডিও নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ক্ষুদ্র বিমান যা নিজেই উড়তে পারে এবং রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে অথবা সফটওয়ারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সক্ষমতা ও ব্যবহারের ভিত্তিতে ড্রোন বিভিন্ন নামে পরিচিত ও বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন- ইউএভি/UAV (Unmanned Arial Vehicle)- এটি রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি চালকবিহীন বিমান। সাধারণত সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যবহূত ড্রোনকে ইউএভি বলা হয়। সাধারণ ড্রোনের তুলনায় ইউএভি দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সক্ষম, যার গতি ও উড্ডয়ন উচ্চতা সাধারণ ড্রোনের তুলনায় বেশি এবং অনেকটা এভিয়েশন মানসম্মত। আবার আরপিএ/RPA/RPAS (Remotely Piloted Aircraft/System)- যে সকল ইউএভি নিয়ন্ত্রণে অধিক দক্ষতার প্রয়োজন হয় এবং তুলনামূলকভাবে ইউএভি এর চেয়ে সংবেদনশীল ও অধিক সুবিধা সম্বলিত ও কার্যকরী তাদেরকে আরপিএ/আরপিএএস বলা হয়।

বর্তমান বিশ্বে ড্রোনের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের ঝুঁকি পরিমাপ করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার চতুর্মুখী নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ (দিবা-রাত্রি এলাকা পর্যবেক্ষণ, পার্কিং, জেলখানা, কলেজ ক্যাম্পাস, স্টেডিয়াম ইত্যাদি) করা যায়। নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে নিরাপত্তা দল কর্তৃক গোপনে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও মনিটর করা যায়। ভিআইপি নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আগে থেকেই অগ্রবর্তী দলের ন্যায় ড্রোন পাঠিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়। দুর্গম এলাকায় অবস্থিত মূল্যবান সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তার বিধান করা সম্ভব হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে অবস্থান নিশ্চিতকরণ ও লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা যায়। জরুরি ত্রাণ সরবরাহসহ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আটকে পড়া লোকদের মাঝে দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ করার জন্য উক্ত এলাকায় কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং কত লোকের জন্য কী ধরনের ত্রাণ প্রয়োজন তা দ্রুত নির্ধারণ করে ডাটা প্রেরণ করা যায়। যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেশি প্রয়োজন সেখানে ড্রোন দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি করে বাহিনীর নিরাপত্তা ঝুঁকি ও খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। ড্রোন দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসের ছবিতোলা, ভিডিও করা, কৃষিকাজ, কলকারখানা পরিদর্শন, আবাসন কার্যক্রম মনিটর, হোম ডেলিভারি, পণ্য সরবরাহ এমনকি বিনোদনের জন্য ব্যবহার হয়। পাইলটবিহীন এই বিমান এখন ডকুমেন্টারি তৈরি, নাটক, ছবি ও বিজ্ঞাপন নির্মাণেও ব্যবহূত হচ্ছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার জন্য ২০১৪ সাল হতে ড্রোন বা কোয়াডকপ্টার (Quadcopter) অনুমতি ছাড়া ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারা ২০১৬ সালে ড্রোন উড্ডয়ন/ব্যবহারের জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সর্বশেষ জানুয়ারি ২০১৯ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত সার্কুলার অনুযায়ী বাংলাদেশে ড্রোন উড়ানো/ব্যবহারের পূর্বে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। যে আবেদনপত্র দাখিল করা হবে তাতে অবশ্যই ড্রোন উড্ডয়নকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, ড্রোন উড়ানোর উদ্দেশ্য (যেমন- প্রশিক্ষণ, চিত্র ধারণ, ভিডিও ধারণ ও গবেষণা ইত্যাদি), ড্রোন এর বর্ণনা (ওজন, টাইপ, নিরাপত্তা ফিচার্স ইত্যাদি), ড্রোন উড্ডয়নের দিন, তারিখ ও সময়, ড্রোন উড়ানোর স্থান এবং এ সংক্রান্ত সমন্বয়, যে স্থানে ড্রোন পরিচালনা করা হবে সেই স্থান হতে হাসপাতাল এবং ফায়ার ব্রিগেড এর দূরত্ব ইত্যাদি তথ্য থাকতে হবে। এছাড়া অন্যান্য নির্দেশনায় উল্লেখ আছে যে, ২০০ ফুট উচ্চতার উপরে কোনো ড্রোন উড়ানো যাবে না। ড্রোন পরিচালনার জন্য অবশ্যই ইন্সুরেন্স/বীমা থাকতে হবে (মানুষ ও সম্পদের ঝুঁকি ও ক্ষতিপূরণসহ বীমা)। বিমানবন্দর হতে ন্যূনতম দূরত্ব হবে- ১৮.১০ কিলোমিটার (১০ মাইল) এবং এর কম হলে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এর অনুমতি নিতে হবে। অন্যান্য স্থাপনা (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সংবেদনশীল সরকারি স্থাপনা, বিল্ডআপ এরিয়া) হতে দূরত্ব হবে ৯ কিলোমিটার (৫ মাইল)। বিল্ডিং, গাড়ি, জাহাজ, মানুষ, পশু ইত্যাদি হতে দূরত্ব হবে ৩০০ মিটার (১০০০ ফুট)। জনবসতিপূর্ণ এলাকা বা জনসমাবেশ এলাকায় ড্রোন উড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ। ড্রোন পরিচালনার নির্ধারিত সময় শুধু দিনের বেলায় এবং পরিষ্কার আবহাওয়ায়। উড্ডয়ন স্থলে ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকতে হবে। যে স্থানে ড্রোন উড্ডয়ন ও অবতরণ করা হবে সেই জায়গার মালিকের অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।

সমরবিদরা আধুনিক যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে সুফল গ্রহণ করছে। পাবলিক এবং প্রাইভেট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য ড্রোন ব্যবহূত হচ্ছে। স্কুল কলেজের খুদে বিজ্ঞানীরা ড্রোন তৈরি করছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রোন তৈরির প্রতিযোগিতা হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা ভেবে ড্রোনের অযাচিত ব্যবহার বন্ধের জন্য ড্রোন উড্ডয়ন নীতিমালার বাস্তবায়ন ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশে যে সকল ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান ড্রোন তৈরিতে পারদর্শী বা ড্রোন নিয়ে গবেষণা করে তাদের সশস্ত্র বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় কার্যক্রম পরিচালনা করলে স্বল্প খরচে বাহিনীসমূহের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের মানসম্মত ড্রোন দেশেই তৈরি করা সম্ভব।

n লেখক : সেনা কর্মকর্তা এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জাহানাবাদ, খুলনা