শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার প্রয়োজন

আপডেট : ১১ জুন ২০১৯, ২১:৩৯

এদেশের আর্থিক খাতের মূল শক্তি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। উচ্চ সুদের হার দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ এবং উচ্চ সুদের হারে বিনিয়োগ করে ফটকাবাজির ন্যায় মুনাফা অর্জন, ঋণ খেলাপীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এমনকি গত বছরে সরকার প্রধানের নির্দেশে ২৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কথা থাকলেও তাদের অনেকেই এখন তা মানছে না। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেও ঋণের উপর প্রদেয় সুদের হার ডাবল ডিজিট। আবার প্রসেসিং ফি অত্যন্ত উচ্চ, পাশাপাশি চার্জেস সিডিউল কোনো কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি। যার উচিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর তদারকি করা, সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। চার্জেস সিডিউল আগে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে জ্ঞাত করানো হতো। এখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে সাধারণ গ্রাহকের উপর চার্জেস সিডিউল মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য সোনালী ব্যাংকের কথা আলাদা। আমি গবেষণা করে দেখেছি, সোনালী ব্যাংক লিঃ ৫৩ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে— যার বিনিময়ে তারা কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ পায় না। জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন। ব্যবস্থাপনাগত কলা-কৌশলের অসহায়ত্বে সেবার মান ক্রমশ নিম্নমুখী করে ফেলছে। এদিকে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ একই স্থানে ঘনীভূত হয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক  গ্রাহক নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে থাকে। ফলে গ্রাহকের সংখ্যা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশে-বিদেশে এবং বাংলায় আভিধানিক অর্থে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও উদ্যোক্তা তিনটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হলেও ইদানীং দেখা যাচ্ছে তিনটি শব্দকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। সারাবিশ্বে উদ্যোক্তার সম্মান অনেক বেশি।  কারণ তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকেন। আর শিল্পপতি যিনি, তিনি দেশের শিল্পায়নে কাজ করে থাকেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী যিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তিনি ব্যবসায় লিপ্ত থাকেন। তাই বলে শিল্পপতি-ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হলেও যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মানুষের আয় প্রবাহে সুষম বন্টন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের আর্থিক উন্নয়নকে বিস্তৃত করে থাকেন তারা সম্মানীয়। এক্ষণে সবাইকে যদি একই তালিকাভুক্ত করে সাধারণ ব্যবসায়ীকেও উদ্যোক্তার সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় তবে তা দেশ ও দশের মঙ্গল হবে না।  বহুদিন ধরে প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. মোহম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি ব্যাংকিং কমিশনের দাবি জানিয়ে আসছি। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

ব্যাংকিং সেক্টরে আজ যে সমস্যার উদ্রেক হয়েছে, তা অতি মুনাফা অর্জনের প্রয়াস থেকেই হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সঠিক মাত্রার লোন প্রাইসিং না করে অপরিকল্পিতভাবে উচ্চমাত্রার আমানত ও বিনিয়োগের উপর সুদ বসানো, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার নামে মাত্রাতিরিক্ত খরচ করা, অত্যধিক বেতন বেসরকারি ব্যাংকে দেয়া, বাসেল-২ ঠিকমতো পালন না করা, ক্যামেলস রাইটিং ঠিকমতো অনুধাবন না করা, আর্লি ওয়ার্নিং সিগন্যাল দেখেও না বোঝা— এগুলো মূলত ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও সঠিক সময়ে মুনাফা অর্জন করা বিশেষত সুপার নর্মাল প্রফিট অর্জন করার ইচ্ছা থেকেই এসব ঘটেছে। আবার যারা ঋণ খেলাপী ছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে সত্যিকার অর্থে বিচারের সম্মুখীন হয়নি। এর অবশ্য কারণও আছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপীদের মামলাগুলো দুর্বলভাবে ব্যাংকারদের দ্বারা সাজানো হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি যারা ঋণ প্রদানের জন্যে তদ্বির ও চাপ প্রয়োগ করে থাকেন তাদের  কখনো মামলার সম্মুখীন হতে হয় না। এমনকি হলমার্ক কেলেংকারির কথাই বলুন কিংবা পূর্বেকার ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ করলেই আমরা দেখতে পাবো সুপারিশকারীরা সব যুগে, সব কালে বেঁচে যায়। এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে মানব সম্পদের মান অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ হচ্ছে পুঁজিস্বরূপ। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, যে, সত্যিকার দিক-নির্দেশনার অভাবে মানবসম্পদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গড়ে উঠছে না। আবার সাধারণ গ্রাহক হয়রানি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ড্রয়ারে চেকের রিক্রুইজিশান ব্যাংকের স্লীপ রেখে পাঁচ মাস পর চেকবই দিতে কেবল গরিমসি করে না, বরং ডিএমডির নির্দেশ উপেক্ষা করে সিনিয়র অফিসার গ্রাহকদের ধমকাতে ও ক্ষমতা দেখাতে  কসুর করে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ঐ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জানিয়েও কোনো ফলোদয় হয় না। আসলে এ ধরনের ঘটনা কোনো বেসরকারি ব্যাংকে ঘটলে শাস্তি পেত। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঠুঁটো জগন্নাথ। একমাত্র সরকার প্রধান পারেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ঢেলে সাজাতে। তিনি নির্দেশ দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

এজন্যে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা রাখতে চাচ্ছি:

১) গ্রাহকদের ন্যায়সংগত অভিযোগের ভিত্তিতে দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দিতে হবে। নইলে দুষ্টচক্র ক্ষমতার দাপট দেখাবে।

২) পরিচালনা পর্ষদ বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের ক্ষেত্রে ঢেলে সাজাতে হবে আর তার ভিত্তি হবে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে যে সমস্ত জ্ঞান, প্রায়োগিক কলাকৌশল, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহারে সক্ষমদের নিয়োগ করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের কেউ নিয়মের বাইরে সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবে না।

৩) ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট লেভেলে নিম্নস্তর থেকে ঊর্ধ্বতন পর্যন্ত Capacity Build up করতে হবে। এ জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ করতে হবে।

৪) বিআইবিএমকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং কেবল পুঁথিগত বিদ্যা ও গবেষণা বাদ দিয়ে সরকারের উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঢেলে সাজাতে হবে।

৫) আইবিবির কেবল মুখস্থবিদ্যার ভিত্তিতে ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম পালটিয়ে ব্যাংকারদের গ্রাহক সেবার মান উন্নতকরণ, যথাযথভাবে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার যাতে ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হোন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৬) যে সমস্ত কর্মকর্তা গ্রাহক হয়রানি করেন, অন্যায়ভাবে ঋণ প্রসেসিং করেন, প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে।

৭) ব্যাংকসমূহকে অবশ্যই উদ্যোক্তা বান্ধব হতে হবে। নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক ঋণ প্রদানের জন্য Seed Money এবং Start up Cost দেওয়ার জন্যে সুস্পষ্ট নীতিমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি যে সমস্ত নতুন উদ্যোক্তাকে অর্থায়ন করা হবে তাদেরকে ১০-১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৮) আমানতের সুদের হার ও ঋণ প্রদানের সুদের হারের মধ্যে যে ব্যবধান  আছে তা ২%-এর বেশি কখনো হওয়া উচিত নয়। একই কথা Exchange Rate-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

৯) বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা যেখানে ১৫ লক্ষ সেখানে বাস্তবে তা বহুগুণ। এ অতিরিক্ত ব্যয় কমানোর জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। Cost cutting পদ্ধতি দরকার।

১০) প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষক, পরীক্ষণের কাজ শক্তিশালী করতে যে কোনো দুর্নীতি চোখে পড়লেই তার বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

১১) ঋণ খেলাপী পুনঃতফসিলকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং তা আদায়ে প্রতিটি শাখায় টিম গঠন করতে হবে।

ব্যাংকিং সেক্টরে যে নৈরাজ্য নেমে এসেছে তা একদিনে হয়নি। বর্তমান সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে হলে ব্যাংকিং সেক্টরে সার্জিক্যাল অপারেশন করতে হবে। এ কাজটি করতে হলে দক্ষ ব্যাংকারের নেতৃত্বে করা দরকার। এদিকে একই স্থানে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের ফলে Crowding Effect হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু কিছু ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় দেশের নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, খুলনায় বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করে সেখানকার সঞ্চয় আমানতের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনকে বাস্তবায়িত করতে হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জন্য পৃথক রেগুলেটরের আওতায় কমিনিউটি ব্যাংকিং স্থাপন করতে হবে। প্রফেসর ড. এ কে এম এনামুল হক গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যথার্থই প্রশ্ন করেছেন যে, ব্যাংক কি কেবল মুনাফা অর্জনের যন্ত্র? আসলে ব্যাংক হচ্ছে জনগণের কল্যাণের যন্ত্র, তাই ব্যাংকারদের প্রয়োজন  মানুষের কল্যাণ ও আয়বৈষম্য দূর করায় মনোযোগি হওয়া।

n লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনোমিস্ট