বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকের দায়

আপডেট : ১১ জুলাই ২০১৯, ২২:২১

এলেখাটির শিরোনাম হয়তো অনেকের মনে একটি ধারণার রেখাপাত করতে পারে। বিষয়টি এখন আমাদের সকলের ভাবনার বিষয়। কারণ একজন শিক্ষকের আন্তরিক সহযোগিতায় আজকের শিক্ষার্থীরাই পারে সমাজের কোনো একটি জটিল সমস্যার সুন্দর সমাধান করতে। যেমনটি জানা যায় ২৩ জুন ২০১৮ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে। জামালপুরের জনাব তৌহিদুল ইসলাম তাপস যিনি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে দেশসেরা উদ্ভাবকের স্বীকৃতির পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিভিশন-২০১৮ এ সেরা উদ্ভাবকের স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। তিনি পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে পেট্রোল, ডিজেল, এলপি গ্যাস ও কার্বন কালি উত্পাদন করেছেন।

তৌহিদুলের এ সাফল্যের পেছনে যিনি তাঁকে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন তিনি হলেন তাঁরই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের রসায়নের শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্রের আগ্রহ দেখে কলেজের রসায়ন গবেষণাগারের চাবিই তাঁর হতে তুলে দিয়েছিলেন। আর এই গবেষণাগার থেকেই তিনি সফলতা অর্জন করেন। দৈনিক ইত্তেফাকের আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়—ভারতের তামিলনাড়ুর একটি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষকের বদলি আদেশ পরিবর্তনের জন্য শিক্ষার্থীদের একটি ভিডিও ইন্টানেটে ভাইরাল হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ঐ শিক্ষকের বদলির আদেশ বাতিল করেন। তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালবাসা ও পড়ানোর আন্তরিকতার জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষককে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলির বিষয়টি মেনে নিতে চায়নি। মূলত উপরিউক্ত দুটো ঘটনা পত্রিকা পড়ার পর এবং বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ১৬ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ লেখাটি লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।

সর্বজনীন শিক্ষার দাবি সকলের—যা আমরা আজও নিশ্চিত করতে পারিনি। সর্বজনীন শিক্ষার সঙ্গে অবশ্যই সরকারি নীতিমালার বিষয়টি সর্বাগ্রে হলেও এর বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে কোনো কোনো শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই দায়দায়িত্ব ঘাটতির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যেমন—গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং-এর রিপোর্ট অনুযায়ী গৃহশিক্ষকতার কারণে ক্লাসে অমনোযোগী শিক্ষার্থীরা (ইত্তেফাক, ১৬ মে ২০১৮)। এছাড়া শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওদের মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণায় (এডুকেশন ওয়াচ-২০১৭) দেখা যায়—প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক, মাধ্যমিকে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চশিক্ষা স্তরের ৭০ শতাংশ এবং শিক্ষকগণের অর্ধেক নিজেদের আদর্শ অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন না (প্রথম আলো ১০ মে ২০১৮)। এটি আমাদের কাম্য নয়। কারণ আমরা সকলেই জানি এবং বিশ্বাস করি শিক্ষকতা অন্য আরেকটি পেশার সঙ্গে তুলনা করা চলে না। জনাব রশিদ তাঁর স্কুলে মাতৃভাষা শিক্ষণ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘লালন শুরু হয় স্নেহ ও প্রাণময়ী মায়ের হাতে এবং সমন্বয়সাধন হয় কৌতুহলী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আন্তরিক এবং অক্লান্ত পরিচর্যায়’ (পৃষ্ঠা ৩২৬)। শিক্ষকের ঘড়ি ধরে প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করলে চলে না। শিক্ষক তাঁর মেধা এবং শ্রম দিয়ে একটি জাতিকে বদলে দিতে পারেন। এটি এমন একটি পেশা যার দায় আছে তাঁর ছাত্রের কাছে, আছে সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে, সর্বোপরি নিজের কাছে। শিক্ষকের মধ্যে এই দায়িত্ববোধের ঘাটতি থাকলে আমরা তাঁকে আদর্শ শিক্ষক বলে মেনে নিতে পারি না।  কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকের আদর্শ, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, আন্তরিকতা, সময়ানুবর্তিতা, অধ্যবসায় সর্বোপরি শিক্ষকের মেধা ও জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মনে প্রভাব বিস্তার করে।

আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যর মূলে ছিল চাকুরিজীবী সৃষ্টি করা। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ দৈনিক সমকালে ‘হূদয়ে শিক্ষা চাই’ শিরোনামের প্রবন্ধে শিক্ষার তিনটি উদ্দেশ্যের মধ্যে বিবেকবান এবং সৃষ্টিশীল মানুষ সৃষ্টি করার বিষয়টি আলোচনা করেছেন। এ ধরনের বিবেকবান মানুষ সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষককে শিক্ষণ-শিখন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হয়। কাজটি সহজ নয়। এছাড়া এটি রাতারাতি করাও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। তাই শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার পূর্বে শিক্ষকের উচিত তিনি নিজে কতটুকু প্রস্তুত এবং কতটুকু যত্নশীল—তা যাচাই করা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ‘গরিমা’ ছাড়া ‘গুরু’ হওয়া যায় না। আদর্শ শিক্ষকের প্রতি পদে-পদে ‘গরিমা’র বিষয়টি মনে রাখতে হবে। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশে সর্বাপেক্ষা মেধাবী শিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা হয়। এমনকি অধিক ও অভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিকে সর্বনিম্নস্তরে শিক্ষকতার জন্য নিযুক্ত করা হয়। আর আমাদের দেশে হলো তার সম্পূর্ণ উলটো। তবু শিক্ষককে তার নিজের মূল্যবোধ থেকেই তাঁর শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে। কারণ সার্থক শিক্ষার সবচেয়ে বড় উপকরণ হলো শিক্ষক—যিনি শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ইত্যাদি দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন। শিক্ষক উপযুক্ত না হলে গুণগত শিক্ষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে অযোগ্য শিক্ষক সেই ভাবনাগুলোকে শুরুতেই ধ্বংস করে ভবিষ্যত্ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিতে পারেন। শিক্ষা হতে হবে শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রিক। এডুকেশন ওয়াচ-২০১৭-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শিক্ষকের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন দৃঢ়তা, প্রেরণা ও নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শিক্ষার্থীদের পথ দেখান তাহলে বড় পরিবর্তনের সূচনা হবে। তাই শিক্ষক তাঁর মেধা, শ্রম এবং সর্বোপরি নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আদর্শ রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রকে অবশ্যই আদর্শ শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

n লেখক : এমআএসটি, মিরপুর সেনানিবাসে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত