শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বর্ষার দুঃখ-সুখের কোলাজ

আপডেট : ১৪ জুলাই ২০১৯, ২১:২৩

জয়া ফারহানা

বৈশ্বিক উষ্ণতার চোখ রাঙানিতে ইউরোপের আকাশ যখন ইউরোপিয়ানদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশের আকাশের চৌকাঠে তখন উঁকি দিচ্ছে তিমির কুন্তলা বা কাজল ঘন মেঘপুঞ্জ। বৃষ্টি যে কী অসীম ঐশ্বরিক দান সেটা বৃষ্টিবিহীন অঞ্চলের অধিবাসীরাই বোঝেন কেবল। দুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম তামিলনাড়ুতে স্বর্ণের চেয়ে জলের মূল্য বেশি। খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে এ কারণেই হয়তো বৃষ্টিবন্দনার শেষ নেই। একটু বেশি বৃষ্টি পাওয়ার জন্য কত যে লৌকিক আচার আয়োজন পালন করে তারা। তামিলনাড়ুর কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি পড়লেই সেখানকার নারীরা ব্যাঙ ধরে এনে তার মাথায় পানি ঢেলে দেয় যেন বৃষ্টির পরিমাণ একটু হলেও বাড়ে। আমরা প্রকৃতির বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত। আমাদের এই মাটি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রাবল্যের কারণে জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তত কয়েক হাজার মিলিলিটার বৃষ্টিপাতের ভূখণ্ড। লক্ষ্য করেছেন, বৃষ্টি ধন্য শেষ আষাঢ়ের এইসব দিনে কখনো সকালের চঞ্চল রোদ সারাদিন বৃষ্টি ঝরিয়ে বিকেলে আবার কী প্রসন্ন শ্রান্ত শান্ত হয়ে উঠছে? আবার কখনো দুপুরের সজল মেঘ সময়ের আগেই ডেকে আনছে অপরাহ্নের অবসন্ন আলো? সমস্ত জলভার না নামালে মেঘেরই বা তৃপ্তি কোথায়? মৌসুমী বায়ুর ভরন্ত এই সময়ে ঈশান কোণে মেঘ অনেকটা ধ্রুপদী সংগীতের আলাপের মতো। ‘আলাপ’ শুনে শ্রোতা যেমন সুরের আবেশে মগ্ন হওয়ার প্রস্তুতি নেন তেমন মেঘ দেখে রোদে পোড়া বিবর্ণ ঘাসের শিষ থেকে শুরু করে শৈবাল, প্রবাল, ঝিনুক, শামুক, সেপিয়া প্রকৃতির প্রত্যেকে সুখানুভূতিতে আবিষ্ট হয়। বর্ষা শেষে ময়ূরের পালক খসে পড়ে। নতুন পুচ্ছ গজাতে সময় লাগে আরো পাঁচ-ছয় মাস। ময়ূরের চাঞ্চল্য বর্ষার সৌন্দর্যের আরেক মাত্রা। শুধু কি ময়ূর? কোটি কোটি বছর ধরে বৃষ্টি ধরে রেখেছে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণসত্তা। প্রতিটি প্রাণ তাই তার প্রাণবিন্দুর মাধ্যমে টের পায়, বর্ষা এসে গেছে। বর্ষা এসেছে। বাংলার অবিরল অনলবর্ষী বর্ষা।

সমুদ্রের প্রবল জলসংঘাতে তৈরি হওয়া বাষ্পই মেঘ হয়ে ওঠে আকাশে। সেই মেঘ কোথা থেকে কোথায় যে উড়ে যায় কে জানে তা! তবে জানতে ইচ্ছে করে, বর্ষার মেঘ প্রতিবছরই একই পথ ভ্রমণ করে আসে নাকি এক মহাদেশের আকাশের জল বাষ্প হয়ে উড়ে অন্য মহাদেশের আকাশে মেঘ হয়ে ভাসে? মেঘ বা বৃষ্টি শব্দ দুটি যতটা ছোটো, মোটেই তত ছোটো নয় এর পরিধি। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে প্রশস্ত পরিধি নিয়ে আছে মেঘ, বৃষ্টি। আকাশে একচিলতে মেঘের দেখা মিললেই আটপৌরে রসুই ঘরের ঘ্রাণ চেহারা দুই-ই বদলে যায়। ইলিশ পাতুড়ি, সর্ষে ইলিশ, পুদিনা পোস্ত ইলিশ, আম সর্ষে ইলিশ, কচু বেগুন ইলিশ, মালাই ইলিশ, ইলিশের এলাহি আয়োজন। সঙ্গে খিচুড়ি, শেষপাতে চাটনি। বর্ষা যত ঘন এবং নিবিড় হয়ে আসে জিভ ও আবেগের তোয়াজ তত বাড়ে। সে কারণেই কি বিষ্ণু দে লিখেছেন— ‘চেরাপুঞ্জি থেকে একখানা মেঘ ধার দিতে পারো, গোবি সাহারার এই বুকে?’ যে কথা জীবনভর মনের গোপনে যত্নে লালিত হচ্ছিল তা বলার জন্য বেয়াড়া হয়ে ওঠে মন। কবিতার ব্যাকরণ বলে, কবিরা ছন্দ শিখেছেন বৃষ্টির ছন্দের কাছ থেকে। মৌসুমী অঞ্চলে মেঘভেজা বায়ুপ্রবাহের কারণে টানা ছয়-সাতদিন যে বৃষ্টি হয় পুরাণে তার নাম শিব ঠাকুরের সাতকন্যা বৃষ্টি। শিব ঠাকুরের সাতকন্যা বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় এক এক করে। তাদের একেকজনের অশ্রুর ফলশ্রুতি একেকদিনের বৃষ্টি। আছে পূর্ব মেঘ, উত্তর মেঘ নিয়ে অনুরাগঘন ‘মেঘদূত’। ‘জাতং বংশের ভুবন বিদিতে পুষ্করা বর্তকানাং, জনামি ত্বাং প্রকৃতি পুরুষং কাম রূপং সখোনং’। হে মেঘ, আমি জানি, ভুবন বিস্মৃত তুমি পুষ্কর আবর্তের বংশজাত। আর ইন্দ্রের সেবক তুমি তাই ইচ্ছেমতো নাও নানান রূপ। মেঘের অনুরাগ যথার্থই বুঝেছিলেন কালিদাস। বুঝেছিলেন শুদ্রকও।

কোনো সুখই নিরবচ্ছিন্ন নয়। এবার বর্ষায় নাগরিক জীবনে অন্যান্য দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। বিভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ বিপত্সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উপচে-পড়া তিস্তা ও ধরলা দেখে কবিতাপ্রেমীরা যত রোমাঞ্চিতই হন এই দুই নদী পারের ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ এবং উজানের ঢলে তিস্তার প্রবাহ দোয়ানি পয়েন্টে বিপত্সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। সুরমার প্রবাহ বিপত্সীমার ৯০ সেন্টিমিটার ওপরে। আশঙ্কা আছে বন্যার। যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ অংশের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙছে নদী। আরো কিছু নদী ভাঙনের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। এবছর নদীভাঙন অন্যবারের তুলনায় বেশি।

বৃষ্টির নান্দনিক মাত্রা আছে। প্রাণরক্ষার জন্য অনিবার্য প্রয়োজনও আছে। তবে ভালো হতো নান্দনিক, ছান্দসিক এই বৃষ্টি যদি সকল মানুষকে একটি ভারসাম্যের জায়গায় রাখতে পারত।

n লেখক : প্রাবন্ধিক