আরাফাত শাহীন
বর্তমান পৃথিবীর সকল দেশকেই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের সকল দেশের ভাবনা-চিন্তার পরিধি কি একই রকম? এর উত্তর হলো, না। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই বিষয়টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এর কারণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দ্বারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং চীন বর্তমান বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের দিক দিয়ে সামনের কাতারে রয়েছে। এছাড়া বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করছে তাতে পৃথিবীর ক্ষতির পরিমাণ মোটেও সামান্য নয়।
বিশ্বের যে-সমস্ত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ অন্যতম। অতীতে বেশ কয়েকবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেসব বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেছেন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশও। এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণের হার যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এবং আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে যে-হারে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।
এবার আমরা আলোচনা করব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ কীভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সংঘটিত দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর এবং প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কথা মনে আছে? আমাদের কারো আসলে সেই দুঃসহ স্মৃতিকে ভোলার উপায় নেই। সে সময় ঝড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি জেলা ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রায় ৮৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি? এর পরিমাণ আনুমানিক ১৬ হাজার কোটি টাকা! চিন্তা করা যায়! আমাদের দেশের মতো একটা দরিদ্র দেশের জন্য এই ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশাল। দেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগটি। এখনো আমরা সিডরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো এখনো দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে কেন এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানল আমাদের দেশে? শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই মাঝে-মধ্যে টর্নেডো, ভূমিকম্প, ভূমিধস, বন্যা, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। এর কারণ হলো, জলবায়ুর পরিবর্তন। আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে জলবায়ুর প্রকৃতি যেমন ছিল এখন ঠিক তেমনটা আর নেই। প্রকৃতি এখন ক্রমশ চরমভাবাপন্ন হয়ে পড়ছে। এর কারণ, মানুষের অবিবেচকের মতো কাজকর্ম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো থেকে প্রকৃতি সব সময় আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু আমরা সেই প্রকৃতির সঙ্গে কেমন আচরণ করছি? আমাদের আচরণ আদৌ কি বন্ধুসুলভ? আমরা নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছি। যে গাছ প্রকৃতি থেকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে মানববসতিকে টিকিয়ে রেখেছে আমরা কীভাবে তাদের প্রতি এমন বিরূপ হতে পারি! সভ্যতা ও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আমরা এক সময় যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলেছি সেভাবে প্রকৃতিও আজ আমাদের ওপর তার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছে।
পরিবেশের এই ভয়াবহ বিপর্যয় রোধ করতে হলে প্রথমেই আমাদের প্রচুরসংখ্যক গাছ লাগাতে হবে। আমাদের সবুজের বেষ্টনি তৈরি করতে হবে। একমাত্র গাছই আমাদের এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। উপকূলীয় এলাকায় প্রচুরসংখ্যক গাছ লাগাতে হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের বাড়ির আঙিনায় সবুজে ভরে ফেলতে হবে। প্রতিটি শহরে যাতে প্রচুরসংখ্যক গাছ লাগানোর ব্যবস্থা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই মাতৃভূমি যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমরা যদি এই দায়িত্ব সকলে মিলে সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারি তাহলেই হয়ত জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
n লেখক :শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়