শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এ বিবাদ মেটাতেই হবে

আপডেট : ১৫ জুলাই ২০১৯, ২১:৩৪

মুহা. রুহুল আমীন

কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদি নেজাদের পর নম্রপন্থি হাসান রুহানি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। রুহানির মোহনীয় ব্যক্তিত্ব ও আকর্ষণীয় নেতৃত্বের বদৌলতে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশসমূহ এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাঁর শাসনামলে ইরানে পাশ্চাত্য সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল  হতে থাকে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের ইরান নীতিতে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেন। ইরানের সঙ্গে পক্ষশক্তি + এক রাষ্ট্রসমূহের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনেন এবং ইরানের প্রতি নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জটিল নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করে।

সমকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বৃহত্ শক্তি  ইরানের মধ্যকার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে আঞ্চলিক বৃহত্ যুদ্ধের শুরু করতে পারে, যে যুদ্ধে অতি দ্রুত বৃহত্ শক্তিসমূহের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অত্যন্ত তীব্র।

ইরানের সঙ্গে বৃহত্ শক্তিসমূহের পারমাণবিক চুক্তির স্বাক্ষর ইরান-পাশ্চাত্যের স্থিতিশীল সম্পর্কের নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা করে। চুক্তির নেপথ্যে পাশ্চত্যের লক্ষ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রায়নের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। ততদিনে হাসান রুহানি তার রাজনীতিক দূরদর্শিতায় বুঝেছিলেন, পাশ্চত্যের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে ইরানের শক্তিমানতার প্রতিষ্ঠা করা। উভয় পক্ষের এ সমমর্যাদাপূর্ণ শর্ত পূরণের পরিপ্রেক্ষিতে এ চুক্তিটির যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ট্রাম্পের হঠকারী সিদ্ধান্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তিনি এ সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছের কাছে ইরানকে শর্তহীন আত্মসমর্পণ করতে হবে। নতুন করে এমন একটি পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেদ ধরেন যাতে ইরানের কোনো বক্তব্য বা শর্ত বিন্দুমাত্র বিবেচিত হবে না। এ লক্ষ্যপূরণে প্রথম ধাপেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ঐ চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে ইরানের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেন।

দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা ড্রোন ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে ইরান তা ভূপাতিত করে। ঐ ঘটনার যুক্তরাষ্ট্র দুভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। প্রথমত, ইরানের মিসাইল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সাইবার আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং পরে তা বাতিল করেন। ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার আক্রমণ ইরানের কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বিমান ভূপাতিত করার পর দেশটির হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্য মার্কিন সংবাদমাধ্যমে বিকৃত তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের হুমকি-ধমকির মধ্যে ইরান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, পারমাণবিক চুক্তির ধারাসমূহ মানতে ইরান আর বাধ্য নয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, জার্মানি যদি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রতিকার না করে, তা হলে ইরানও পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে ইরান জানিয়ে দিয়েছে যে, পারমাণবিক চুক্তির দ্বারা ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করা এবং ইউরেনিয়ামের মজুত রাখার যে সীমানা এঁকে দেওয়া হয়েছে, ইরান তা অতিক্রম করবে এবং ইরানের প্রয়োজনে যত খুশি ইউরেনিয়ামের মজুত দরকার ইরান তা গড়ে তুলবে। এমনকি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির পথে ইরান দ্রুত অগ্রসর হবে।

এ অবস্থায় ইরান যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে—এ প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইরান সবসময়ই দাবি করে আসছে যে, দেশটি শান্তিপ্রিয় এবং তারা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে না। যুক্তরাষ্ট্রও ঘোষণা দিয়েছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অগ্নিতে ঘি ঢেলে দেবে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এ দেশটি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সব সময় ফাটল সৃষ্টির তত্পরতা চালাবে।

আন্তর্জাতিক সমাজকে বুঝতে হবে, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের নিক্তিতে ইরান ও ইরানের হাসান রুহানিকে পরিমাপ করা সমীচীন হবে না। ইরান তার দেশের মর্যাদা ও জাতীয় সম্মানকে কখনো ক্ষুণ্ন হতে দেবে না। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বা এর মজুত বাড়ানোর ঘোষণার মাধ্যমে ইরান আসলে পাশ্চাত্যকে ভয় দেখাতে চায়, ইরানের শর্তকে পরিষ্কাররূপে বুঝিয়ে দিতে চায় এবং ইরানের শক্তির প্রমাণ  করতে চায়। গত ৭ জুলাই দেশটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২০১৫ সালের জয়েন্ট কমপ্র্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) শীর্ষক পরমাণু চুক্তির শর্ত ভাঙার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে তারা চুক্তি  উপেক্ষা করে ইউরেনিয়ামের মজুত ৩০০ কিলোগ্রামের ওপর নিয়ে গেছে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির হার ৩.৬৭ শতাংশের বেশির করার কাজে হাত দিয়েছে।

এ মুহূর্তে বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিবদমান পক্ষদ্বয়কে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে ফোনালাপ করেছেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বসার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত নির্ধারণের ব্যাপারে দুই প্রেসিডেন্ট একমত হয়েছেন। ইরানের গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রী মাহমুদ আলাভি আলোচনার জন্য দুটি পূর্বশর্তের কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ ব্যাপারে অনুমোদন দেবেন। ইরানের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন রাশিয়া, চীনসহ ফ্রান্স ও জাতিসংঘ ইরানের চুক্তিভঙ্গে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে চীন ও রাশিয়া মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত ইরান-নীতির কারণেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। ইরান স্পষ্টত বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়ায় তার কর্মপন্থা ও নীতির রূপরেখা দিয়েছে। ইরানের সর্বশেষ কথা হলো ইরানকে আইএইএ কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক অধিকারের চর্চা থেকে সরানো যাবে না এবং ইরানের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনর্নিমাণে নিষেধাজ্ঞা বাতিলসহ সামান্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ইরানের কোনো নেতা বা কোনো প্রেসিডেন্ট দেশটির এ জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে কোনো পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে পারবে না। ইরানি জনগণ দেশবিরোধী কোনো নীতি গ্রহণ করবে না। ইরানের জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণ্ন্ন রাখার মূলনীতি বজায় রেখেই ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব সমাধান একনিষ্ঠ হতে হবে। এক ফুত্কারে নিভিয়ে দেওয়া, যায় এমন একটি দেশ নয় ইরান। কাজেই তাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা নিয়েই কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো দায়িত্বশীল মহল থেকে ইরানকে তাচ্ছিল্য করে নানা মন্তব্য করেছেন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র স্টেফ্যানি গ্রিসাম এক মন্তব্যে বলেন, ইরানকে কোনোভাবেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া ঠিক হয়নি। ইতিপূর্বে হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কখনো ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না এবং সে লক্ষ্যে দেশটির ওপর তারা অব্যাহত চাপ রাখবে। কিন্তু পাশ্চাত্যকে এ সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হলে চলবে না যে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থা আইএইএ প্রণীত নীতির আলোকে অনুমোদনযোগ্য ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধির পথ থেকে ইরানকে বিরত রাখার জেদ ধরা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে যে মধ্যপ্রাচ্যে দেশটি ইতোমধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। মিত্র রাষ্ট্র ইসরাইলের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অধিপত্য ও ভূমিকার একটি নরক রচনা করা হয়েছে। জেরুজালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থানান্তর এবং যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে  নেয়ায় সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবন্ধী পরাশক্তি রাশিয়ার কাছে নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। চীন ও তুরস্কের অধিপত্য ও শক্তিমানতা মধ্যপ্রাচ্যে এখন নতুন বাস্তবতা। ক্ষয়িষ্ণু যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মধ্যপ্রাচ্যে আগের দাপট বজায় রাখতে সক্ষম হবে না। ইরানের বিরুদ্ধে মিত্র সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে আট বছর প্রক্সি-যুদ্ধ চালিয়েও যুক্তরাষ্ট্র আশানুরূপ জয় পায়নি। আফগানিস্তান, ইরান ও সিরিয়া যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ইরানের সঙ্গে যে-কোনো যুদ্ধের ফলে যে অঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা-হুমকি তৈরি হবে, তা মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলবে। ফলে ইরান ও পাশ্চাত্য উভয়ের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব নিরসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

n  লেখক :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়