শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কেন ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা হচ্ছে না

আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৯, ২১:৫২

হাসনাত আবদুল হাই

রাজধানীতে ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অবশ্য এই বিষয়ে নীরব, যা থেকে মনে হয় সমাসাময়িক সামাজিক ও নাগরিক জীবনের সমস্যা নিয়ে তারা খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। নচেত্ কয়েকটি চ্যানেল থেকে সচিত্র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পরিবেশন করা হতো। দেখা যাচ্ছে, এই সব সমস্যা হলে ধরার জন্য প্রিন্ট মাধ্যমই শুধু অগ্রণী নয়, প্রায় একক ভূমিকা পালন করছে।

সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী রাজধানীতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে একটি বাংলা দৈনিক জানিয়েছেন যে, প্রতিদিন ১৫০ জনের বেশি মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ১৪-১৫ জুলাই তারিখে ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৯৯৮ জন চিকিত্সাধীন রয়েছেন। জানা গিয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ৪৭টি হাসপাতালে তথ্য সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বাইরেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং বিভিন্ন চিকিত্সকের প্রাইভেট চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীর চিকিত্সা হয়ে থাকে, যার হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চলতি মাসের ১-১৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ১৬৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সার জন্য ভর্তি হন। এর আগের মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৫৯ জন। এক তথ্য অনুযায়ী এই বছর জানুয়ারি থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৪৭ জন। এদের মধ্যে এপ্রিল মাসে ছয় জন, জুলাই মাসে এক জন চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঢাকায় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগের কোনো সময়ে এই রোগের এমন ব্যাপক ও ভয়াবহ প্রকোপ আর দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছে বলে সংবাদে প্রকাশ।

অ্যাডিস জাতীয় মশা কামড়ালে ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়—এই তথ্য অনেক পুরোনো এবং সকলেরই জানা। এই প্রজাতির মশা জলাবদ্ধতার জন্য বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক জরিপে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধ স্থানে অ্যাডিস মশার ঘাঁটি দেখতে পাওয়ার তথ্য দিয়েছে। এই বছরের মার্চ মাসে পরিচালিত এই জরিপে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ৫৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে অ্যাডিস মশার কেন্দ্র দেখতে পাওয়া গিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ডেঙ্গু রোগ মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে হাইকোর্ট ১৪ জুলাই এক সুয়োমোটো রুল জারি করেছে। যেখানে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাডিস মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে দুই সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ যেন ছড়াতে না পারে, তার জন্য হাইকোর্টের রুলে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২২ জুলাইয়ের মধ্যে ডেঙ্গু মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বন্ধের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার জন্য দুই সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্টের সুয়োমোটো রুলে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

১৪ জুলাই ইস্যু করা রুলে হাইকোর্টে চার সপ্তাহের মধ্যে উল্লিখিত বাদীগণের বিরুদ্ধে কর্তব্যকর্মের অবহেলার জন্য কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের রুল জরুরি অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১১ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে বেআইনি বলা হয়েছে এবং তাদেরকে এই সব মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে। দেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এবং কার দ্বারা আক্রান্ত রোগীর ক্রমবর্ধমান সংস্থার প্রতি লক্ষ রেখে এই প্রথম এমন কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ (ডেইলি স্টার ১৫ জুলাই) ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নগর ভবনে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত নাগরিকদের চিকিত্সার জন্য মোবাইল হেলথ কেয়ার সার্ভিস উদ্বোধন করবেন বলে জানানো হয়েছে। জানা গিয়েছে এই কর্মসূচির অধীনে ৫৭টি ওয়ার্ডের ৬৭টি মেডিক্যাল টিম, ৪৫৪টি মেডিক্যাল সেন্টার স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে। ১৫ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত চলবে বলে জানা গিয়েছে।

যেখানে অ্যাডিস মশা নিধন করে তাদের প্রজনন বন্ধ করা প্রয়োজন—এই মর্মে হাইকোর্ট থেকে রুল জারি করা হয়েছে সেক্ষেত্রে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিত্সার পদক্ষেপ বেশ বেখাপ্পা এবং হাস্যকর বলে মনে হয়। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিত্সাসেবা, রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যেভাবে দেওয়া হচ্ছে তাতে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। হাসপাতালগুলোর কর্মক্ষমতার ওপর চাপ পড়েছে বলেও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় দুই সিটি করপোরেশনের জরুরি কর্তব্য হলো মশা নিধন করে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার রোগ প্রতিহত করা। চিকিসেসবার চেয়ে এই মুহূর্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা পরিবেশন সেবা সম্পর্কে যে খবর পাওয়া গিয়েছে সেই ভিত্তিতে অন্তত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে প্রতিরোধের ওপর যে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন তা নিশ্চিত করবার জন্য কোনো জরুরি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়নি।

এক বাংলা দৈনিকের খবর অনুযায়ী মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করে সিটি করপোরেশন, সেগুলোতে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান নেই। ফলে স্প্রে করা হলেও অ্যাডিস মশা মরছে না। অ্যাডিসসহ অন্যান্য মশা বৃদ্ধির কারণই হলো মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ ব্যববহার করা হচ্ছে তার মধ্যেও ভেজাল থাকার জন্য অথবা তারিখ ফুরিয়ে যাবার কারণে তাদের কার্যকারিতা না থাকা। মশা নিধনের জন্য উপযুক্ত ওষুধ কেনা এবং তা সময়মতো ব্যবহার না করা একটি পুরোনো সমস্যা, যা সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার পরিচায়ক। যতদিন কেন্দ্রীয়ভাবে সিটি করপোরেশনগুলো মশার ওষুধ ক্রয় করবে এবং ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বে থাকবে, এই অদক্ষতা ও দুর্নীতি দূর করা যাবে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যে ওষুধ কেনা হচ্ছে জনগণ তার গুণমান সম্পর্কে কিছুই জানে না। কেননা তাদেরকে এই সম্পর্কে অবগত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। মশা নিধন করে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করার ব্যাপারে জনগণের কাছে সিটি করপোরেশনগুলোর জবাবদিহিতা প্রায় নেই বললেই চলে। করদাতা হিসেবে রাজধানীর নাগরিকরা জানে না, কত টাকা প্রতিবছর ওষুধ ব্যয় করা হচ্ছে এবং সেই ওষুধের গুণমান কী। সচ্চতা ও জবাবদিহিতার অভাবই মশা ধ্বংস করে ডেঙ্গু রোগ প্রতিহত করার অসম্ভবজনক অবস্থার জন্য যে দায়ী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মশার ওষুধ কেনা ও সেবার ব্যবহারে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের জন্য অবিলম্বে ওষুধ কেনা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় সংসদ সদস্য, মিডিয়ার প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ক্রয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। মশা নিধনের ওষুধ কেন্দ্রীয়ভাবে সিটি করপোরেশনের প্রধান দপ্তরে না দিয়ে বিকেন্দ্রিতভাবে ওয়ার্ডের মাধ্যমে ছিটানো প্রয়োজন। তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাই নিশ্চিত হবে। ওয়ার্ডের জনগণ সহজেই জানতে পারবে তাদের এখানকার জন্য কোন ওষুধ ও কী পরিমাণ দেয়া হয়েছে। এর ফলে ওয়ার্ড কমিশনার এবং তার কাছে ন্যস্ত মশা নিধনকারী কর্মচারীর ওপর এখানকার নাগরিকদের পক্ষ থেকে নজরদারি করার সম্ভব হবে এবং তারা নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করার চাপ দেবে।

মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য গতানুগতিকভাবে কাজ করলে উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এই রোটিন উদ্দেশ্য পূরণ ও দায়িত্ব পালন এবং হাইকোর্টের সম্প্রতি ইস্যু করা রুলের নির্দেশ পালনের জন্য সিটি করপোরেশনের গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে নতুন পদ্ধতিতে জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো অজুহাতে সিটি করপোরেশগুলো তাদের প্রচলিত পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে নতুন আঙ্গিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে কাজ করার বিষয়ে ইতস্তত করতে পারে না।

মহামান্য হাইকোর্টের সুয়োমোটো রুল রাজধানীতে যে প্রায়-দুর্যোগ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। দুই সিটি করপোরেশনকে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

n লেখক : কথাশিল্পী ও সাবেক সচিব