বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আরশিনগর

দুই কিংবদন্তি শিল্পীর স্মরণে

আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৯, ২১:২৩

১৫জুন সন্ধ্যায়, একাদেমি অফ ফাইন আর্টসে, সদ্য প্রয়াত রবীন মণ্ডল আর বিপিন গোস্বামীর স্মরণসভায়, শিল্পাঙ্গনে নানা মুখের ভিড়ে নিঃসঙ্গ প্রেমিকের মতো বসে আছি। ভেতরে ঝড় বইছে। উথলে উঠছে তাঁদের সঙ্গযাপনের দিনগুলো, রাতগুলো।

সসজ্জ পরিসরে, রবীন মণ্ডলের জন্ম হাওড়ায় আর বিপিন গোস্বামীর উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে। দুই জনই বংশপরম্পরায় পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা। তবু বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তাবোধ আমাকে সবসময় অবাক করে।

উনিশো একাত্তর, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য সময়। তাঁরা তখন টগবগে যুবক। রক্তে তাঁদের শিল্পকর্মের অতৃপ্ত তরঙ্গ। রবিনদা, সুনীল, শক্তি, সন্দীপনের সহযাত্রী বন্ধু। অন্তর্মুখী বিপিন সবার গুণমুগ্ধ, নিবিড় পাঠক। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সেনার বর্বরতায় ক্ষুব্ধ, আবার মুক্তিযুদ্ধে রাশি রাশি ছাত্রযুবকের মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে সবাই উদ্বেলিত। কফি হাউসে প্রতিদিন ঝড় উঠছে। পূর্ববঙ্গের সাহিত্যের পুনর্মূল্যায়ন শুরু। লেখক কবিরা জনমত গঠনে ব্যস্ত। এখানে-ওখানে সমাবেশে সরব সবাই।

শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশকে নিয়ে এক নাগাড়ে ছবি আঁকছেন দুঃসাহসী ভাস্কর রামকিঙ্কর। কলকাতায় স্টেটসম্যান ভবনের সামনে বসে ছবি এঁকে, বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল গড়তে উদ্দীপ্ত প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, সুনীল দাস, রবীন মণ্ডল ও অন্যান্য শিল্পী। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে ঐসব লেখক শিল্পীর উচ্ছ্বাস তুঙ্গে উঠল। কবিতায়, চিত্রতলে ফুটে উঠছে বঙ্গজনতার নতুন দেশের মানচিত্র। মুহুর্মুহু কণ্ঠে বাজছে—জয় বাংলা। ঐ স্মৃতি, ঐ উল্লাস ম্লান হবার নয়। চিত্রকর্মের অন্যতম বিশ্বপথিক রবীন মণ্ডল বহুবার ঢাকায় গেছেন, আর্টক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন, তাঁর ছবি ওখানকার কারো কারো সংগ্রহশালায় সুরক্ষিত। শিল্পকলা ছাড়াও ওখানকার সাহিত্য ও জনজীবন নিয়ে সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। একথা আড্ডার আসরে বারবার বলতেন। তাঁর ভিন্ন চেহারার কিউবিজম ও প্রতীকধর্মিতা, যতটুকু জানি বাংলাদেশের শিল্পীদের তাঁর প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।

আত্মপ্রিয় শিল্পী নন, তাঁর বন্ধুপ্রীতির মতোই বাংলদেশময়তা আর ওখানকার সাহিত্য-মগ্নতায় আমরা অনেকেই প্রাণিত। ঋদ্ধ। এমন একজন দার্ঢ্য, স্নেহপ্রবণ শিল্পীকে হারিয়ে হঠাত্ নিজেকে অভিভাবকহীন আর আশ্রয়চ্যুত লাগছে।

এশিয়ান কিউবিউজমের অন্যতম সেরা চিত্রকর রবীন মণ্ডল, আমাদের রবীনদা শতবর্ষ পূরণের শর্ত অপূর্ণ না করেই এভাবে চলে যাবেন, যেতে পারেন, একথা বিশ্বাস করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছি। ভারী হয়ে উঠছে একধরনের বিষণ্নতা। নির্মেদ দেহ, ধারালো মুখ, চোখে চশমা, মাথায় অক্ষত হালকা চুল, কঠিন হাড়ের বাহু। বাকসংযমী। প্রাণচঞ্চল। বহুমাত্রিক চিত্রকর্মী-৯১ পেরিয়ে শর্তবর্ষের দিকে এগোচ্ছিলেন। তাঁর দেহের গড়ন, ভারহীন বয়স, হাঁটাচলার অনড়ভঙ্গি, প্রতিদিন সকালে, কখনো রাতেও নিয়মিত ছবি আঁকার সুকৌশলী কসরত দেখে মনে হতো, ১০০ পেরিয়েও জেগে থাকবেন। হলো না। আচমকা ভগ্নআশা ঘেরাও করল আমাদের। এক মঙ্গলবার, আরেক কিংবদন্তি, ভাস্কর বিপিন গোস্বামীও ইহজাগতিকের পরিসর ছেড়ে সমাজের শোকবোধকে জোর ধাক্কা দিয়ে গেলেন। ঠিক একসপ্তাহের মোড়ে রবীনদার মতো শিল্পীর মৃত্যুতে সে শূন্যতা বোধ চওড়া হলো, তার শেষ কোথায় কে জানে। ধীরে ধীরে চারপাশের আলো নিভে যাচ্ছে আর আমরা অবাক বিস্ময়ে শোকের বহর স্পর্শ করে বলে যাচ্ছি, শেষ হয়ে গেল একটি অধ্যায়, একটি যুগ। সত্যি কি এরকম কোনো অবসান

ঘটেছে? না এও অন্যরকম অধ্যায়ের শুরু। বিপিন গোস্বামী যে দক্ষতায় ভাস্কর্য বানাতেন, ছবি আঁকতেন রবীন মণ্ডল, তাঁদের ভাস্কর্যের আর ছবির নির্মাণে যে দৃঢ়তা, যে মনন আর ঐতিহ্যের বিস্তার দ্যুতি ছড়ায়—এইসব ধারাবাহিকতার অবলম্বন আর অনুসরণ যদি আমাদের মনন আর সৃষ্টিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করতে থাকে, তাহলে মৃত্যুকে মৃত্যু বলা যাবে না। শূন্যতাবোধের তাত্ক্ষণিকতাকে অতিক্রম করে শিল্পী ও ভাস্করেরা লাগাতার অনুভব করবেন তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। এখানেই মৃত্যু হেরে যায়। জয়ী হয় ইহজাগতিকতার সৃজনশীল স্বপ্ন।

সল্টলেকে রবীনদা আর বিপিন গোস্বামীর বসবাস ছিল একই আবাসনে, আলাদা দুই ফ্ল্যাটে। এই অভিন্ন-ভিন্নতা তাঁদের শিল্পকর্মেও অদ্ভুতভাবে প্রতিফলিত। একজন ভাস্কর। অন্যজন তাঁর জীবদ্দশাতেই কালজয়ী শিল্পী হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিকতাবোধ আর সীমান্তহীন খ্যাতিতে দুই জনেরই অর্জনের গৌরব বহুমুখী বহুবিস্মৃত। মেধা আর মননে উভয়েই একে অন্যের স্বাস্থ্যময় প্রতিদ্বন্দ্বী। পারস্পরিক বন্ধুত্বের মহিমাও অসামান্য।

একজন মূর্তি গড়ার কৌশলে, আরেকজন ছবির নির্মাণ ও সৃষ্টিতে, কোমল কাঠিন্যে যে শিল্পধারার স্থাপন করে গেছেন, যে লৌকিক, আদিম জগেক ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে এসেছেন, তা ভারতীয় শিল্পের অমূল্য সঞ্চয় হয়ে থাকবে।

শৈশবে কঠিন অসুখ, একাধিক মৃত্যুশোক, বালক বয়সে স্কুলে যেতে না পারা আর বাড়িতে একা দিনযাপনকে ঘিরে তীব্র অভিমান তৈরি হয়েছিল রবীন মণ্ডলের। স্মৃতিচারণ, আত্মবৃত্তান্তে একথা কখনো কখনো বলেছেন। অসুখে গৃহবন্দি কিশোর জানালা দিয়ে জগত্ দেখতেন। জানালার চোখ ক্রমশ মুক্ত উন্মুক্ত হতে থাকে এবং শিল্পকর্মই তাঁর যাপনের আশ্রয় হয়ে ওঠে, পরে যা পেশায় পরিণত আর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রূপকল্পের চেহারা নেয়, রেখাচিত্রে বা বড়ো বড়ো ক্যানভাসে। রবীনদার পড়াশুনোর পরিধি সম্পর্কে আমরা খানিকটা ওয়াকিবহাল। বাংলা কথাসাহিত্য, সমকালের গদ্য-পদ্যের বহুমুখী কৌশল ও নির্মাণের সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে নিবিড় তাঁর পরিচয়।

তাঁদের ভাষা ও ভাবনা, সৃষ্টির রহস্যময়তাকে সঙ্গী করে, সমসাময়িকতাকে পেরিয়ে চিত্রতলে তিনিও গড়ে তুলতেন এক অদ্ভুত, অভিনব বর্ণোজ্জ্বল সংসার। তাঁর চিত্রকল্প, তাঁর ব্যবহূত প্রতীক সাধারণত কিম্ভূত, কখনো নিঃসঙ্গ, যন্ত্রণাবিদ্ধ, হাহাকার নিয়ে স্তব্ধ—আবার এই স্তব্ধতা ও সঙ্গ-নিসঙ্গতার অন্তরালে, ক্যানভাসের বিস্তৃতিতে ছড়িয়ে থাকে নিঃশব্দ সংগীত। নির্জনে জ্বলে ওঠা আগুনে প্রান্তিক ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মুখ দেখেছেন রবীনদা।

আবহমান লোকশিল্পের পরিণত, সংযত প্রতিবিম্বের শিল্পিত স্বভাব তাঁর ছবির, তাঁর ভাবনাচিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। যেখানে শিল্পশর্ত অক্ষত এবং স্থানও কালের মাত্রাকে ছাড়িয়ে তাঁর চিত্রকর্ম বিশ্বজনীন। তৈলচিত্রে, অ্যাক্রেলিকে যে সব বড়ো বড়ো ছবি এঁকেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই রং ব্যবহারের উচ্চতা বিস্মিত করে দেয়। চওড়া রঙের স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসে পীড়িতজনের কান্না ও হাহাকার। রঙের আড়ালে ডুবে থাকে শিল্পীর আমিত্বহীন আমি আর বহির্মুখী অবয়বে বেজে ওঠে নৃত্যরত বিষাদ।

পিকাসো কিংবা ইউরোপের চিত্রকররা যে ভাষায় কিউবিজম নিয়ে মগ্ন ছিলেন একসময়, তার অনুকরণের চিহ্ন নেই রবীন মণ্ডলের ছবিতে, মোটা দাগের রেখাপাতে। জ্যামিতিক ঘরাণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মানবদেহের স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিকে চুরমার করে গড়ে তুলেছেন অস্বাভাবিক অবয়ব।

এখানেই তাঁর ভাবনা ও সৃষ্টি অনন্য। এখানেই তিনি এশিয়ান কিউবিজমের ভিন্নতর সাফল্যময় রূপশিল্পী। আগ্রহ ছিল নানা বিষয়ে। ধ্রুপদী সংগীতেও। রাজনীতি, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা নিয়েও রাগ-অনুরাগের ব্যাপ্তি তাঁর নিকটজনদের উদ্বুদ্ধ করত। এমন একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তি ও শিল্পীকে স্যালুট জানিয়ে আমরা আপাতত বিদায় জানালাম। এ বিদায়ে শোক আছে, তাপ আছে। তিনি যে আবার জাগ্রত হয়ে উঠবেন, শেষ বিদায়কে অগ্রাহ্য করবে তাঁর শিল্পকর্ম ও শিল্পসত্তা—এ বিশ্বাস কম নয়। তাই বলছি, রবীনদাও মৃত্যুহীন এবং শাশ্বতরূপের এক অদ্বিতীয় ভাষ্যকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে নানা ভাবে ঋণী। আমাদের সাংগঠনিক উদ্যোগে, আমাদের বিস্তারে রবীনদার অবদান অতুলনীয়। এরকম এক আত্মীয়কে হারিয়ে স্তম্ভিত, বিমর্ষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। জানি এ মুহূর্ত সাময়িক। তাঁর ছবি নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে যাথাসম্ভব জেগে থাকব। এভাবেই তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বলতাকে উদযাপন করব আমরা।

n লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, সম্পাদক, আরম্ভ পত্রিকা