শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কিশোর গ্যাং :এখনই প্রতিকার প্রয়োজন

আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৯, ২১:৩০

আল-মাহমুদ

সাধারণ অর্থে কিশোর গ্যাং বলতে বোঝায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠা কয়েকজনের একটি গ্রুপ বা একই এলাকার কয়েকজন কিশোর মিলে তৈরি হওয়া একটি দল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে উঠছে এ ধরনের গ্যাং বা গ্রুপ। গ্রুপের নাম বিভিন্ন ‘হরর ফিল্ম’ ও ভিডিও গেমস থেকে নেয় তারা। স্কুল-কলেজের কিছু ছাত্র আড্ডা দিতে দিতে গড়ে ওঠে ছোটো ছোটো গ্রুপ। একসঙ্গে ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া, খেলা আর আড্ডার মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা তাদের বন্ধুত্ব একসময় সহিংস হয়ে ওঠে। ছোটোখাটো সন্ত্রাস, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ পেছনে ফেলে এই কিশোররা ড্রাগ, খুন এমনকি ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যেটা সর্বপ্রথম সবার চোখে পড়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরায় কিশোর আদনান হত্যার পর। যে ঘটনার তদন্ত রহস্য উদ্ঘাটনে বের হয়ে এসেছিল কিশোর গ্যাং-এর কথা। এরপর ২০১৮ সালেও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তাদের মাধ্যমেই।

এলাকার কিশোরদের গ্রুপিং ও সিনিয়র-জুনিয়র সমস্যার জের ধরে খুন হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। তাদের মাঝে নেতৃত্ব আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে কোন্দল সৃষ্টি হওয়ায় মারামারি থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত হচ্ছে। তাদের গ্রুপে নিয়মিত অংশগ্রহণে দিনভর আড্ডাবাজি, রাতে মোটরসাইকেল রেস এমনকি মাদকের ধারাল ফাঁদে পড়ছে এই স্বপ্নত্রয়ীরা। যার ফলে তারা হারাচ্ছে চমত্কার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত্।

সম্প্রতি কয়েক মাসের ব্যবধানে কয়েকটি কিশোর খুন হওয়ায় বিষয়টি উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। গত ৭ জুলাই গাজীপুরের টঙ্গীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নবম শ্রেণির ছাত্র শুভ আহমেদ (১৬) হত্যা মামলার প্রধান আসামি মৃদুল হাসান পাপ্পুসহ (১৭) কিশোর গ্যাং গ্রুপের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। আটককৃতদের জবানবন্দিতে উঠে আসে ভয়ংকর সব কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য। ডিসকো ভয়েস, নিউ নাইন স্টার, নিউ আইকন, ডেন্জার বয়েস ইত্যাদি কিশোর গ্যাংয়ের নাম।

সম্প্রতি কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক ও সংস্কৃতি অঙ্গনে পদার্পণ করার মনমানসিকতা নেই বললেই চলে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তারা এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক ও  সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মনোসংযোগের অভাব অনেক সময় তাদেরকে অপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। মা-বাবার নিকট হতে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া কিশোরদের জন্য বড়োই উদ্বেগের বিষয়। এর পাশাপাশি তাদের নতুন করে সবকিছু বুঝতে শেখার এই সময়টাতেই যদি ‘ক্ষমতা’ বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তবে তারা সহিংসতাকেই হাতিয়ার মনে করে। বর্তমান সময়ের কিশোররা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সেই সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করছে। যেটা অপরাধ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

কিশোরদের এমন বিপথের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় কী? এখনই সময় তাদেরকে সুপথে ফেরানোর। যার জন্য আমাদের প্রত্যেকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমরা জানি, বাংলাদেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে অন্যটি যশোরে। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো শিশু অপরাধে জড়ালে তাদের সাধারণ কারাগারে না পাঠিয়ে বড়োদের মতো শাস্তি না দিয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় এবং তাদের মানসিকভাবে শোধন করার ব্যবস্থা করা হয়।

এই শোধন প্রক্রিয়াই কি দেশের কিশোর গ্যাং অপরাধ নিধন করতে পারবে? হয়তো সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কি আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে? না, এই সমস্যার সমাধানের জন্যে যা যা প্রয়োজন এখন তাই করতে হবে। প্রথমত এখনই সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। পরিবার থেকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে, অনুশাসনের মাধ্যমে একজন সুনাগরিক তৈরি করতে পরিবারকেই বড়ো ভূমিকা রাখতে হবে। সন্তানকে টাকা প্রদানে সচেষ্ট থাকতে হবে। নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়াসহ যথাসাধ্য সময় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কেন কিশোর গ্রুপ কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে এবং কেন আমাদের কিশোরদের মধ্যে ড্রাগ আসক্তি-খুন-ধর্ষণের মতো হিংস্র ও বিকৃত অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে, তার কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে। এর জন্য দরকার অনেক বড়ো পরিসরে গবেষণা। সরকারিভাবে অনুসন্ধানের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অতীব প্রয়োজন। সরকারিভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরা যদি এগিয়ে আসেন এবং তাদের নিজ নিজ এলাকায় কিশোর গ্যাং অপরাধ বন্ধ করেন এবং কিশোরদের কল্যাণকর কাজে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান খুব সহজে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনের উদ্যোগে সংশোধিত পরিকল্পনা করতে পারে আমূল পরিবর্তন।

n লেখক : শিক্ষার্থী, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা