বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মাছের কান্না :হালদা দুর্যোগ ও অন্যান্য

আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৯, ২১:৩১

নূশরাত বিথী

হালদা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্ রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি)  প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। এটিই দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র, যেখান থেকে সরাসরি রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের রুইজাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। এই প্রাকৃতিক জিন পুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রগুলোতে ইনব্রিডিংয়ের কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং বামনত্ব, বিকলাঙ্গতাসহ বিভিন্ন ধরনের জিনগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দ্রুত বর্ধনশীল বড়ো আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি মাছ একসময় রূপকথার গল্পের মতো মনে হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ জন্য বর্তমানে মত্স্য চাষি ও হ্যাচারি মালিকেরা রেণু পোনার জন্য আবার হালদার পোনার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। হালদা একমাত্র নদী, যেখান থেকে আহরিত ডিম স্মরণাতীত কাল থেকে স্থানীয় জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাচীন পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খননকৃত মাটির গর্তে (কুয়ায়) ফোটানো হয় এবং চার দিন লালন করে রেণু পোনা (Fish Fry) তৈরি করা হয়। এই নদীর রুইজাতীয় মাছের বৃদ্ধির হার অন্যান্য উেসর মাছের তুলনায় অনেক বেশি (যেমন কাতলা বছরে ২.০-২.৫ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়)। এতে মত্স্য চাষি ও হ্যাচারি মালিকেরা হালদা নদীর রুইজাতীয় মাছের চাষ কিংবা প্রজনন ঘটিয়ে বেশি লাভবান হতে পারেন। ব্রিটিশ আমলে সারাদেশের দুই-তিন অংশ পুকুরে মত্স্য চাষ তথা একোয়াকালচার হালদার পোনা দিয়েই করা হতো। এমনকি ভারত এবং মিয়ানমারেও হালদার পোনা চাষের জন্য নিয়ে যেত। বর্তমানেও পরিকল্পিতভাবে হালদা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। বর্তমান বাংলাদেশের আট শতাধিক কার্প হ্যাচারি (রেণুর চাহিদা ২ লাখ কেজি প্রায়) তথা বাংলাদেশের একোয়াকালচার এবং বায়োডাইভারসিটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদার প্রাকৃতিক উেসর গলদা চিংড়ি ও মেজর কার্পের পোনার গুরুত্ব অপরিসীম।

হালদা নদীর  জেলেপরিবার ও হাজার লোকের জীবন-জীবিকা কিন্তু আজ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে।

মা মাছের নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র এই হালদা নদী আজ মানুষের লোভের মুখে তার স্বাভাবিক যাত্রা থেকে লক্ষচ্যুত হয়েছে। মহাসংকট যেন হালদার চারপাশে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক যুগপত্ পদক্ষেপের অভাব রয়েছে এখানে। মা মাছ শিকার, নদীর বালু উত্তোলন, নদী দখল, নদীর বাঁক কাটা, ইত্যাদি।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কতিপয় লোভী মত্স্যজীবী খালের মধ্যে বিষ প্রয়োগ করেছে।

প্রতিনিয়ত নদীতে বিভিন্ন শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এসে পড়ছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে হাজার হাজার টন মুরগির খামারের বিষাক্ত বর্জ্যসহ অনেক পচাগলা পদার্থ পানিকে দূষিত করছে। সপ্তাহকাল ধরে খালবিলে পানির নিচে জমে থাকা পচাগলা পদার্থ পানিকে বিষাক্ত করেছে।

এ ছাড়া হালদার সব উপখালে মুখের সব কটি স্লুইসগেট নষ্ট হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। ফলে খালবিলে পানি একরকম আটকা ছিল। দীর্ঘ সময় জমে থাকা খালবিলের পানি দূষণের মাত্রা সর্বাধিক পর্যায়ে চলে যায়। এই পানি এখন নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। লোকালয়ে জমে থাকা বিষাক্ত পানি নদীতে পড়ার কারণে মাছ মারা যেতে পারে।

এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জলাশয় ভরাট করে ঘরবাড়ি তৈরি করছে, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ। কৃষিজমিতে ব্যবহূত কীটনাশক বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাশয়ে পড়ে পানি বিষাক্ত করছে, ফলে মাছ মারা যাচ্ছে।

আসুন প্রকৃতির রূপ ও ভারসাম্য রক্ষায় জলকন্যা হালদা নদী ও মাছের অন্যান্য উত্স  বাঁচাতে সবাই সচেতন ও সোচ্চার হই। মাছের কান্না থামানো যে আমাদেরই দায়িত্ব।

n লেখক :শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়