শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাংলাদেশে দক্ষ মানবসম্পদ প্রসঙ্গ

আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৯, ২১:৫৫

দক্ষ মানে বুদ্ধির সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা এবং বিশেষজ্ঞ মানে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন। বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় বিশেষ কাজে, বিশেষ মুহূর্তে; তবে দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন সব ক্ষেত্রে, সব কাজে এবং সব সময়। সমাজ এবং দেশের ক্ষেত্রে দক্ষতার জন্যই একটি দেশের সব কাজের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। একটি দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় এবং সরকারের কাজ সঠিক সময়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন বলা চলে। উন্নয়নমুখী সরকারের প্রধান কাজ থাকে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা। উন্নয়নের প্রধান উপকরণ দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির সঙ্গে চিন্তার খোরাক সরবরাহের হোতা বিশেষজ্ঞেরও প্রয়োজন আছে প্রত্যেক দেশে।

বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশে উন্নতির প্রতিযোগিতা সাধন হয় বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের এই প্রয়োগের প্রধান হাতিয়ার মানুষ। মানুষের এই দলে একদল বিশেষজ্ঞ এবং আর একদল দক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কাজ করার উপকরণ সরবরাহ করবেন এবং অন্যদল তাদের দক্ষতার মাধ্যমে নিশ্চিত করবেন পরিকল্পনামতো কার্য সম্পাদন। এই কর্ম প্রতিযোগিতার জগতে যেদেশের মানুষ যতবেশি দক্ষ সে দেশ উন্নয়ন প্রতিযোগিতায় তত সম্মুখে। শিক্ষায় যেদেশ উন্নত সেদেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয়ও ততবেশি। বিশ্বের ১০টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় আয় (Per Capita Nomonal) এবং শিক্ষার হার দেখে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে:

২০১৯ সালে বিশ্বের মোট ৭৭১.৬২ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১৬.৫০ কোটি। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশে ১৬.৫০ কোটি মানুষ সংখ্যায় অনেক তবে যদি মানবসম্পদের গুণাগুণের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারত তাহলে বাংলাদেশ সিংগাপুর, জাপানের সমপর্যায়ে না থাকলেও উন্নত বিশ্বের তালিকায় থাকতে পারত। উন্নত বিশ্বের তালিকার প্রধান শর্ত দক্ষ মানবসম্পদ। সেই দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন যাবত্ বিশ্বব্যাপী চলছে কার্যক্রম। United Nation Development Program এর প্রস্তাবে ১৯৮৯ সাল থেকে UN বিশ্ব সদস্য দেশসমূহে প্রতি বছর ১১ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস যার প্রতিপাদ্যও Reproductive Health and Gender Equality যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির প্রধান অন্তরায়।

১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। যাত্রার সূচনায় ছিল ৭.৫০ কোটি মানুষ। বর্তমানে ১৬.৫০ কোটি যার প্রায় ৪.০০ কোটি মানুষের দৈনিক আয় প্রায় ১০০ টাকা। তারা না পারে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংস্থান করতে, না পারে সন্তানের শিক্ষার ব্যয় বহন করতে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। তারপরেও বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৭২.৭৬ শতাংশ (UNESCO 2016)। এখানে উল্লেখ্য, প্রতিবছর ০.৬৫ কোটি মানুষ দরিদ্র হয় চিকিত্সা ব্যয় মেটাতে গিয়ে (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০৭/০৮/২০১৬ইং তারিখ)। যদিও দীর্ঘদিন যাবত্ বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ যেমন মানুষ তেমনি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়ও মানুষ, দক্ষতার অভাবের জন্য। বাংলাদেশের ১৬.৫০ কোটি মানুষের মধ্যে ৪.০০ কোটি মানুষ উন্নয়নের মিছিলে শরীক হতে পারছে না কারণ তাদের দৈনিক আয় ১০০ টাকা। দেশের এই উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদার সংস্থান, যা আমাদের সংবিধানে বলা আছে। সরকার করেও যাচ্ছে কিন্তু দিনশেষে উন্নয়নের ফসল টেকসই হচ্ছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় করার পর বছর শেষে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করে ঠিকই; কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের হার বাংলায় ৫৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ১৯ শতাংশ এবং গণিতে ২২ শতাংশ (দৈনিক বণিক বার্তা, ১৭/০৪/২০১৮ইং তারিখ)। বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে উন্নতির; সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের। সরকার কাজ করছে ঠিকই কিন্তু চেষ্টার সুফল পাচ্ছে না দেশের সাধারণ মানুষ। সরকারের চেষ্টার ফসল নিয়ে নিচ্ছে একদল সুবিধাভোগী। দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য সরকারকে হতে হবে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে দিলদরিয়া আর দিন শেষে সরকারের কাজের ফসল আদায়ের জন্য হতে হবে বেনিয়া। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির এই কাজে সরকার পাশে পাবে দেশের জনগণকে। দ্রুত সময় চলে যাচ্ছে। আজ যারা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের জীবনে সুদিনের চিন্তা শেষ। আমরা আর সময় এবং মানবসম্পদ নষ্ট করতে চাই না। শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে জন্মের পর থেকেই। শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অভিভাবক, ছাত্র, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক এবং সরকার। সবার মিলিত প্রয়াসে সন্তানের শিক্ষা কার্যক্রমে সফলতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তবে সেক্ষেত্রে সরকারের হাতেই চাবিকাঠি। সরকার যেমন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তেমনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। মোটকথা, আমাদের প্রধান কাজ হতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা।

n লেখক :চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-ইডিএ