শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিনেমা হলে আমার প্রথম অনুপ্রবেশ

আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৯, ২১:৫৬

সিনেমা হলে বন্ধুদের নিয়ে একত্রে মুভি দেখার আনন্দটাই আলাদা।  আর সেটি যদি হয় জীবনের প্রথম সিনেমা হলের অভিজ্ঞতা, তাহলে তো কথাই নেই।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের কাছে সিনেমা হল ছিল নিষিদ্ধ নগরী।  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সেই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হলেও সময় ও সুযোগের অভাবে কখনো সিনেমা হলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘অনুপ্রবেশ’ দেখার সুযোগ হয় গত ১৯ তারিখে। আমিসহ আমরা ১৫ জন যথাসময়ে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে পৌঁছি। আমাদের মধ্যেকার অনেকেরই ছিল কোনো সিনেমা হলে মুভি দেখার এটিই প্রথম অভিজ্ঞতা। ছোটোবেলায় ফেরদাউস একবার সিনেমা হলে যাওয়ার জন্য ২০ টাকা চুরি করে, কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখা আর হয়ে ওঠেনি। এরকম অসংখ্য টুকরো স্মৃতি সবার মানসপটে ভেসে উঠছিল।

বাংলা সিনেমাপোকা ছিলাম ছোটোবেলায়। বিটিভি’র কল্যাণে বাংলা সিনেমার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম খুব ভালোভাবেই। অসংখ্য বাংলা সিনেমার কাহিনি ছিল আমার মুখস্থ। যখনই নায়িকাকে নিয়ে ভিলেন দৌড়াবে তখনই হঠাত্ আকাশ থেকে উড়তে উড়তে নায়ক এসে হাজির হবে। তারপর শুরু হবে ঢিশুম-ঢাশুম। একা নায়কের বাহুবলে আট-দশ জন ভিলেন ঘায়েল। অথবা নায়িকা অভিমান করে ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে আত্মহত্যা করতে গেছে। নায়ক বাইককে বিমান বানিয়ে এসে মুহূর্তের জন্য রক্ষা করে ফেলে নায়িকাকে।

কিন্তু কী মুশকিল! ‘অনুপ্রবেশ’ সিনেমায় এসব কিছুই নেই। আর যা আছে, তা আমাদের প্রথাগত চিন্তার বাইরে। এজন্য ‘অনুপ্রবেশ’ সিনেমাটি বাংলা চলচ্চিত্রে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন বলে আমার মনে হয়েছে। এটাকে একটা ‘দার্শনিক সিনেমা’ও বলা যেতে পারে। পুরো সিনেমায় অসংখ্য দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত হয়েছে।

সিনেমার নায়ক অরিষ্ট তার প্রেমিকা অবন্তিকে নিয়ে মোটরবাইকে নদীর পাড়ে ঘুরতে বের হয়। সেখানে রহস্যময় দুর্ঘটনায় নায়ক মারাত্মক আহত হয়ে কোমায় চলে যায়। কোমায় থাকাকালীন অবস্থায় নায়কের মনে হয়, ভিনগ্রহের আরেকটি প্রাণী তার প্রেমিকার রূপ ধারণ করে তার মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সেই এলিয়েন মেয়েটি নায়ক অরিষ্টকে সিংহ হয়ে হরিণের মাংস ভক্ষণের স্বাদ দেয়, আবার হরিণ বানিয়ে সিংহের থাবায় মৃত্যুর স্বাদ দেয়। দুজনে ব্যাঙ হয়ে যৌনানুভূতির স্বাদ নেয়। আবার প্রাচীন আরণ্যিক জীবনের ভেতরে অরিষ্টকে ফেলে দেয় এলিয়েন মেয়েটি। সেই জীবনে স্ত্রী-সন্তানসহ সংসারধর্মের মায়াময় অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা করে দেয় এলিয়েন মেয়েটি।

প্রকৃতির অপরূপ রূপের ব্যবহার এই মুভিটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। উঠে এসেছে মনুষ্য প্রজাতি কীভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার অশনি সংকেত। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের মতো এমন অসচেতন প্রাণীর আবির্ভাব নিতান্তই ‘অনুপ্রবেশ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়েছে সচেতন মানবসমাজের দায়িত্বশীল অবদানের কথা।

মুভিটি আমাদের একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়, যেখানে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হবে পৃথিবীর রক্ষাকারী। পারমাণবিক বোমার মরণখেলা কিংবা কার্বনের অনিয়ন্ত্রিত উদ্গীরণ নয়, সবুজের সমারোহে পৃথিবীতে গড়ে উঠবে স্বর্গীয় পরিবেশ। জীবজন্তু এবং উদ্ভিদরাজিও রক্ষা পাবে এবং পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করবে। এসব নানা দিক মিলিয়ে ‘অনুপ্রবেশ’ সিনেমাটি বাংলা সিনেমার এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেছে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা অনুপ্রবেশের পরিচালক তাপস কুমার দত্তের জন্য দুঃসাহসিক কাজও বটে। কারণ, এই ছবির ভেতরে প্রতিটি ঘটনার নেপথ্য সূক্ষ্মতা এত বেশি যে, এর কোনো দৃশ্যাংশ কিংবা এর কোনো সংলাপ মিস হলে ছবির পরবর্তী দৃশাংশের লজিক বুঝতে কষ্ট হতে পারে। এজন্য এই ছবিটি চোখ দিয়ে দেখার পাশাপাশি মাথা দিয়েও দেখতে হয়। বাংলা সিনেমায় এমন জটিল ভাবনার প্রকাশ এভাবে আগে কখনো হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।  

আমাদের দেশের চলচ্চিত্র জগত্ প্রায় নির্জীব। কিন্তু মানসম্মত সিনেমা এখনো দর্শক আকর্ষণ করতে পারে। সমাজে সৃষ্টি করতে পারে আলোড়ন। সিনেমা একটি জাতির সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। সিনেমার মাধ্যমে ফুটে ওঠে জাতির সভ্যতা, শিষ্টাচার, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন। সত্যজিত্ রায়, জহির রায়হানদের সিনেমা আজো বাঙালির হূদয়ে বিশাল স্থান দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য সিনেমা আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আগামীর প্রতিভাবান তরুণদের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছবে—সেই প্রত্যাশা করি।

n লেখক : শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়