শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমার এল ডোরাডো

আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ২১:২৪

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিই কি উন্নয়নের ‘স্পিডব্রেকার’? কেন তাকে কেউ কেউ এভাবে বিদ্রুপ করেছেন? কখনো কাছে বসে, কখনো দূর থেকে? বঙ্গভূমির হালের গতিময়তা—কলকাতার চাকচিক্য, দিবারাত্রির ঝকঝকে রাস্তা কি তাদের নজরে আসে না? আমরা বহু বিদেশি নাগরিককে বলতে শুনেছি—‘শহর বড্ড দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’ ঘরবাড়ির বিন্যাস, গাড়ির দুরন্তপনা, একাধিক উড়ালপুলের সহজিয়া উচ্ছ্বাস আর নাগরিক সুযোগ-সুবিধা—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো মনোহর রাজধানীর বিকাশকে তোমাদের শহর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিমানবন্দরে নেমে একটু এগোলেই মনে হয়, নবীন প্রেমের টানে পুরাতনের আবর্জনাকে সে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। একান্ত আলাপচারিতায় সম্প্রতি শহরের প্রাণচাঞ্চল্য, গতির দ্রুততা দেখে ঠিক এই ভাষায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতির ইরানি চলচ্চিত্রনির্মাতা মজিদ মাজিদি। মজিদ শুধু চলচ্চিত্রকার নন। বহুমাত্রিক তার পরিচয়। বাক্স্বাধীনতা আর সাংস্কৃতিক বহুত্ব নিয়ে তার সরব লড়াই, তার অবিরত লেখালেখি মুগ্ধ করে দেয় আমাদের। এক দেশ থেকে আরেক দেশে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়। পারিপার্শ্বিকের ক্রুদ্ধ, অবরুদ্ধ ও সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের ভাষা তার মুখস্থ। ভিন্নতর চোখ ও দূরদৃষ্টি  দিয়েই কলকাতার হালের চালচ্চিত্র খতিয়ে দেখেছেন মজিদ মাজিদি।

ঠিক একই উচ্চারণে কয়েক মাস আগে নির্মীয়মাণ নতুন কলকাতার বিকশিত, প্রজ্বলিত নগরচিত্র নিয়ে বিস্মায়িত মনোভাব জানিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবীর। সাংবাদিক, বহু তথ্যচিত্রের স্রষ্টা ও সর্বক্ষণের মানবাধিকার কর্মী। ঢাকার মতো কলকাতাও যেন তার আরেক ঠিকানা। অতএব, মজিদ অথবা শাহরিয়ারের  মতো, বহু শহর দেখা পর্যটকরা যখন আমাদের মহানগরের দেহ বদলের চেহারা দেখে অবাক বিস্ময়ে, সানন্দ উচ্চারণে বলেন, কলকাতা তার পরম্পরাকে অক্ষত রেখে বাড়ছে, তার সৌষ্ঠব আমাদের মুগ্ধ করছে, তখন এখানকার যাপনে অভ্যস্ত আমরা চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, অচেতনকে সচেতন করে তাদের কথা শুনতে বাধ্য হই। ভাবতে হয়, সত্যি কি কলকাতা পুরোনো ঐতিহ্যকে জড়িয়ে নতুনের পথে, অবিরত ছুটছে?

২০১১ সালে, রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মমতা যখন বলেছিলেন, কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে দেব, গঙ্গায় টেমস নদীর শোভা ঝলমল করবে। আলোহীন রাস্তায় তারা ঝিলমিল রাত জেগে উঠবে, তখন অনেকের বিদ্রুপের রাজনীতির কটূক্তি আর বাঁকা ভ্রূকুটির বাক্য বিদ্ধ করেছে মুখ্যমন্ত্রীর আগ্রহ আর স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকারকে। আজ ঘরোয়া আলাপে বিরুদ্ধ রাজনীতির অনেকেই কলকাতার রূপান্তরকে মেনে নিচ্ছেন, মানতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ সমাজের উঁচুনিচ কণ্ঠস্বর নগরের নব নব বিন্যাসে খানিকটা বিস্মিত। আশ্বস্ত। নির্বিশেষের এসব স্বীকৃতিকে অস্বীকার করা কি সম্ভব, সংগত? স্বাস্থ্যময় মতভেদ থাকতেই পারে। সমাজচিন্তায়, রাজনীতির বহুত্বে তার গুরুত্ব এড়িয়ে যাওয়া অন্যায়। প্রশাসন, সরকার, কিংবা সরকারের প্রধানতম প্রতিনিধি জনহিতার্থের ইচ্ছা নিয়ে যখন ছুটতে থাকেন, অসুন্দরে সুন্দরের চেহারা সাজিয়ে তোলেন, পরিবেশের শ্রীবৃদ্ধিতে বিশেষ বিশেষ প্রকল্প রচনা করে, রচনার স্বাদ আর আহ্লাদকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উত্সাহসী ও দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন, তখন কি আমরা তার সাংগঠনিক, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে রাজনীতির অপচ্ছন্দ দিয়ে হেয় করব? লাগাতার লঘু করতে থাকব ব্যক্তিবিশেষ অথবা সম্মিলিত বিশ্বাসের সদিচ্ছাকে?

এত কথা বলার কারণ, ফুলের জলসায় ঝাড়বাতি দেখেও কেউ কেউ পেছনের অন্ধকারকে বুকে নিয়ে  হাঁটছেন। আর চোখ সামনে রেখেও গ্যালিলিও নাটকের পুরোহিতের মতো বলে যাচ্ছেন, ‘কিস্সু হচ্ছে না। যা হচ্ছে, সবই লোক দেখানো নাটকীয় অঙ্গভঙ্গি।’

এই ধরনের নেতিকথা মেনে নিতে পারছি না। কলকাতা এগোচ্ছে। ভেতরে ও বাইরে বাড়ছে। মৃত শহর, ক্ষয়িষ্ণু শহর, নবায়নে দিশাহীন শহর—এসব রটনার লাশ অচিরে শ্মশানের ভস্ম হয়ে ভেসে যাবে। অপ্রতিরোধ্য গতি, প্রাণচাঞ্চল্য আর নান্দনিকতার দিগিবদিকে খুলে দেবে নয়া জমানার নির্মাণ ও নির্মাণের অভিমুখ।

ভারতের সব বড়ো শহর বদলাচ্ছে। কলকাতার অদল-বদলের রীতি আর ছবি সম্পূর্ণ আলাদা। আবহমানকে  পাশে রেখে নবীনতার উদ্যমকে সে বরণ করতে চাইছে। তার উত্সাহ, তার উদ্যম, তার নবায়নের কসরত এখনো অসমাপ্ত, কিন্তু অঙ্গে অঙ্গে, অন্তরের গৃহকর্মে, বহির্ধর্মে সৃষ্টির যে ঝোড়ো আনন্দ বইছে, নিজের অতিশয় আর ক্ষুদ্রকে দূরে সরিয়ে প্রিয় এই পরিচিত শহরকে আমরা বারবার খতিয়ে দেখছি।

পেশাগত দায়িত্ব শেষ হয় রাত ৯টায়। বাড়ি ফিরে প্রায় প্রতিদিন বেরিয়ে পড়ি। গুনগুন গানের অভ্যাসে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে নির্মুক্ত বাতাস এসে পরকীয়া প্রেমের মতো নিঃশব্দ, নিষ্পাপ সূক্ষ্মতাকে জাগিয়ে রাখে। এখানে-ওখানে থামি। অচেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলি। কখনো ছুটে যাই গঙ্গার তটরেখায়। কখনো নিষিদ্ধ এলাকার গলির মোড়ে, ভেতরে অপেক্ষমাণ চাঁদগুলির দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ ভাগ্যলেখা পড়ার চেষ্টা করি। রাত ১২টা পর্যন্ত এরকম নৈশবিহার চলতে থাকে। গাড়ির স্টিয়ারিং, শূন্য আসন, এফ এমের রং-ঢং তখন আমার সঙ্গী। রাতের শহরকে, নগরের হালচালকে দেখার এই মজা আলাদা। যেখানে বিরহের ভার, বন্ধুত্বের অস্বাভাবিক ভাঙন অতিক্রম করে—আমার আমিকে খুঁজি, খুঁজতে থাকি। নস্টালজিয়া হারিয়ে যায়, সচেতনভাবে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিই, কেননা তার সাজানো হরফ, প্রাচীন হাসি, তার মোহাচ্ছন্ন খিদে আর লিপ্সা ধাতে সয় না। কলকাতার নবমুখী বিন্যাস, নির্মাণমুখর প্রতিশ্রুতি আমাকে নিয়ে যায় ষোড়শ শতকের সমৃদ্ধ এল ডোরাডোয়, যার বৈভব কেবল বানিয়ে বলা সত্য নয়, মানুষের সৃষ্টি আর বেদনার এমন এক বুড়ো ইতিহাস, যার ক্ষয় নেই, বিশেষায়িত ধর্ম নেই, ধ্বংস নেই। শাশ্বত চেতনার মতো যার প্রবাহ, যার খরস্রোত, কেবল আমাকে নয়, আমাদের অনেকের স্তিমিত চৈতন্যে শিস দেয়। পুরোনো, পরিত্যক্ত ও অনিন্দ্য যাপনের সঙ্গে শহরের নবাশ্রিত সংকল্প আর নাগরিকতার জাগ্রত, নির্মীয়মাণ স্পর্ধা প্রতিস্পর্ধাকে সংযুক্ত করে তোলে।

রূপান্তরিত কলকাতা, ফ্লাইওভারে উড়ন্ত কলকাতা, ঝকঝকে কলকাতা প্রতিদিন, প্রতিরাতে হয়ে ওঠে আমার এল ডোরাডো। ঝুঁকি ও ঝোঁকের সর্বজয়ী ভালোবাসা। যার আকাশে মেঘ জমে, মেঘ সরে যায়। যার জমিন আর রাস্তা হঠাত্-বৃষ্টিতে কিছুক্ষণ থইথই করেও জৌলুস টিকিয়ে রাখে, সংঘবদ্ধ চেষ্টায় দূরে-অদূরে পালিয়ে গিয়ে জমে-ওঠা জল ডুব দেয় জলে।

n লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, সম্পাদক আরম্ভ পত্রিকা