বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পে-চ্যানেলই পারে বেসরকারি টিভিকে সুরক্ষা দিতে

আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:১২

দেশে বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়লেও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে চ্যানেলগুলো পরিচালনায় নিত্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বাজার প্রসারিত না হওয়ার কারণেই এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞাপনের বাজার বৃদ্ধি না পাওয়ায় এবং দেশীয় বিজ্ঞাপন বিদেশি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ায় বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর উপার্জন ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ কারণে প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার সমন্বয় করতে অধিকাংশ বেসরকারি টিভি কর্তৃপক্ষকেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে প্রোগ্রাম সেকশনে কর্মরতসহ সবার মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

টিভি চ্যানেলের আর্থিক সামর্থ্য কমে যাওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার সমন্বয়ের কারণে প্রতি মাসেই নীরবে-নিভৃতে বিভিন্ন চ্যানেল থেকে কর্মীরা চাকরি হারাচ্ছেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এই সংকটের মূল কারণ হলো—পে-চ্যানেল পদ্ধতি প্রবর্তিত না হওয়া, সীমিত বিজ্ঞাপন-বাজার, বিজ্ঞাপন-বৈষম্য, পক্ষপাতদুষ্ট টিআরপি জরিপ এবং একই সঙ্গে বিদেশি চ্যানেলগুলোর তীব্র আধিপত্য। সম্প্রতি আমরা দেখছি, আর্থিক সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ার কারণেই অনেক টেলিভিশন মিডিয়ার অবস্থা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যময় নয়। অনেকেই হতাশ হয়ে টিভি সাংবাদিকতা পেশা থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

নতুন নতুন বেসরকারি টেলিভিশন আসার কারণে বিজ্ঞাপনের বাজার আরো ছোটো হয়েছে। কেননা গত কয়েক বছরে যে কয়টি নতুন চ্যানেল এসেছে সেই হিসাবে বিজ্ঞাপনের বাজার ততটা বাড়েনি। এ কারণে অনুমোদন নেওয়ার পর জাঁকজমকপূর্ণভাবে চ্যানেল শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে দেখা গেছে। এদিকে টেলিভিশন চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের বাজারে এখন বড়ো ভাগ বসিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে, পণ্য উত্পাদক ও বিপণনকারীর ঝোঁক এখন বেশি অনলাইন বিজ্ঞাপনের দিকে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তৃতির কারণে সব ধরনের মিডিয়াতেই নানান ধরনের পরিবর্তন আসছে। আর তাই বিজ্ঞাপনের বড়ো অংশ চলে যাচ্ছে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসআপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন খুবই শক্তিশালী। থ্রিজি, ফোরজি-সুবিধা এবং স্মার্টফোনের দ্রুত বিকাশের কারণে এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে মানুষ দ্রুত কানেক্ট হচ্ছে। সামনের দিনে মানুষ টেলিভিশন সেটের সামনে বসে টেলিভিশন কতটা দেখবে সেটাও দেখার বিষয়।

গত পাঁচ বছরে দেশের তিনটি শীর্ষ মোবাইল অপারেটর—বাংলালিংক, গ্রামীণফোন ও রবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রায় ৮০০ কোটি টাকার মতো খরচ করেছে। এই বিজ্ঞাপন খরচ দিনে দিনে আরো বেড়ে চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে কীভাবে, কী পরিমাণ বিজ্ঞাপন হারাচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আগামী দিনেও ফেসবুক, ইমো, গুগল, হোয়াটসআপ ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমগুলো আরো বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।

বিজ্ঞাপনের বাইরে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর বিকল্প আয়ের উত্স এখনো তৈরি হয়নি। এই খাতে সরকারের কোনো ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। এদিকে কেব্ল অপারেটররা দর্শকদের কাছ থেকে টেলিভিশনের বিভিন্ন কনটেইন্ট প্রদর্শন করে যে অর্থ উপার্জন করে, তার ন্যায্য একটা অংশ প্রাপ্তি থেকেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বঞ্চিত। সারাদেশে এখন কেব্ল সংযোগের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এই ২ কোটি গ্রাহক প্রতি মাসে কেব্ল সংযোগদাতাকে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে প্রদান করে থাকে। সেই হিসাবে কেব্ল অপারেটররা মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়ার কথা। কিন্তু এই আয়ের কোনো অংশ পায় না টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। পে-চ্যানেল সিস্টেম চালু না হওয়ার কারণেই বেসরকারি টেলিভিশন মালিকরা এই ন্যায্য উপার্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে বিজ্ঞাপন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত যে টিআরপি জরিপ পদ্ধতি, তা নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতেই টিআরপি জরিপ যারা করে থাকে, তারা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে না। ফলে টেলিভিশনগুলো এই কথিত মানদণ্ডের ফাঁদে পড়ে সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই জরিপ কর্তৃপক্ষ অনেক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেও কোনো অনুষ্ঠানকে হাই-টিআরপি প্রদান করে থাকে। এই পদ্ধতি নিয়ে খোদ অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল অনার্সও (অ্যাটকো) সম্প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, বর্তমান টিআরপিতে চ্যানেলগুলোর অবস্থান সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। এর আগেও এই জরিপ পদ্ধতি নিয়ে অনেক টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, কলাকুশলীও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। অনেকেরই অভিযোগ ছিল এই জরিপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সম্প্রতি অ্যাটকো যেহেতু এ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে, সেহেতু সবার স্বার্থেই টিআরপি নিয়ে একটি সর্বজনীন বিহিত হওয়া প্রয়োজন। এটি হলে অন্ততপক্ষে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন-বৈষম্য কমে আসবে। বহুবার টেলিভিশন মালিকপক্ষ থেকে কলাকুশলীরা বলেছিলেন, টিআরপি হলো বিভীষিকারূপী এক দৈত্যবিশেষ। কথিত এই টিআরপির উত্থান ও পতনের কারণে অনেক অনুষ্ঠানের অপমৃত্যু হয়েছে।

বর্তমানে আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণেই দেশের চ্যানেলগুলো জিটিভি বা স্টার জলসার মতো বিগ বাজেটের অনুষ্ঠানও তৈরি করতে পারছে না। স্বীকার করতেই হবে যে, নারী দর্শকদের বৃহত্ অংশ আজ জি বাংলা, স্টার জলসা, ভারতীয় বাংলা ইটিভি, হিন্দি জিটিভি, স্টার প্লাসসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত। আর এই সুযোগে বিজ্ঞাপনের একটি অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশি চ্যানেলে। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কয়েক মাস আগে দেশি চ্যানেলগুলোর আর্থিক সংকট মোকাবিলায় দেশের বিজ্ঞাপনগুলো বিদেশি চ্যানেলে প্রচার না হওয়ার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে কঠোর নির্দেশনাও দেন। এ বছরের ২ এপ্রিল সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের টিভি চ্যানেলগুলো যে পরিমাণ বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন পাওয়ার কথা, বর্তমানে তা পাচ্ছে না। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে দেশীয় বিজ্ঞাপন বাবদ ৫০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকা অন্যদেশে চলে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিন-ফিড হিসেবে অথবা ফিল্টার করে সম্প্রচার করতে হবে। ২০০৬ সালের কেব্ল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আইনের ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতদিন এ আইনটি পালন করা না হলেও আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে আইনটি কার্যকর করা হবে।’

দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এখন যে সংকটের মুখোমুখি তা থেকে উত্তরণের উপায় হলো দ্রুততম সময়ে পে-চ্যানেল সিস্টেমের পাশাপাশি বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, স্বচ্ছ টিআরপি জরিপ নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য শিল্পের মতো টেলিভিশন চ্যানেলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থায়ী জমি বরাদ্দ করা। আশার কথা, টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো সম্প্রতি পে-চ্যানেল সিস্টেম চালুর বিষয়ে মতৈক্য পোষণ করেছে। গত ২৭ আগস্ট অ্যাটকোর এক সভায় বলা হয়, বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দ্রুত পে-চ্যানেলে রূপান্তর করতে হবে। এরপর ২৮ আগস্ট অ্যাটকোর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও অন্যান্য দাবির সঙ্গে কেব্ল টিভি সম্প্রচার কার্যক্রম ডিজিটাইজেশনের আওতায় এনে সব চ্যানেলকে পে-চ্যানেলে রূপান্তর করার দাবি উপস্থাপন করেন। একই সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দ্রুত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার করবে বলে জানান।

আশা করি, মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আমাদের দ্রুত বর্ধনশীল ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোকে টিকিয়ে রাখতে অ্যাটকোর মতামতের সঙ্গে সমন্বয় করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেসরকারি টেলিভিশনের এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তবে একই সঙ্গে টেলিভিশনগুলোকেও মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণসহ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।  

n লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি