শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পানির সংকট এবং পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৩১

মীর আব্দুল আলীম

দেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটছে না। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় নিরাপদ পানির সংকট অত্যন্ত প্রবল। শিগগির পানির সংকট কাটবে না এমন সংবাদই পত্রিকায় দেখলাম। রাজধানীবাসীর জন্য এটা দুঃসংবাদই বটে! সংবাদে বলা হয়েছে, চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহের পরিমাণ বর্তমানে অনেকটাই কম। পানি যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা বিশুদ্ধ নয়।

নদনদীর দেশ বাংলাদেশে রয়েছে পানির সংকট! ১৬ কোটি মানুষের ৯৭ শতাংশের পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলেও বিশুদ্ধ পানির অভাব এ দেশেও প্রকট। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাড়ে ৯ কোটি মানুষই বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মার ৬০ ভাগ এলাকা জুড়ে চর জেগেছে। তিস্তা অববাহিকায় বিরাজ করছে হাহাকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।

ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন এলাকায় দৈনিক পানির চাহিদা ২২৫ কোটি লিটার। এর মধ্যে উত্পাদন হচ্ছে ২১০ কোটি লিটার। এ পানির সবটাই আবার পানযোগ্য নয়। অনেক এলাকায় সরবরাহকৃত পানি ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ, সেখানে ওয়াসার পানিবাহী গাড়ির মাধ্যমে সমস্যা কিছুটা নিরসনের সুযোগ থাকলেও এক্ষেত্রেও রয়েছে দুঃসংবাদ। ঢাকা ওয়াসার ৩২টি পানি সরবরাহকারী গাড়ির ১২টিই বিকল। মূলত সুপেয় পানির সংকট প্রকট হয়েছে। রাজধানীতে কেবল খাবার পানি নয়, ব্যবহারের পানিও মিলছে না কোনো কোনো এলাকায়।

ঢাকা ওয়াসার পানি দূষিত হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে ৪টি প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। তা হলো—১. ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদী থেকে সরবরাহ করা পানি সঠিক উপায়ে শোধন না করা, পানির জলাধারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করা তদুপরি শোধনাগারে পানি শোধনের সময় সঠিক পরিমাণে শোধন কেমিক্যাল না দেওয়া, ২. পর্যাপ্ত দূরত্ব রক্ষা না করে সমান্তরালে পানির লাইন ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন স্থাপন, নাগরিক সচেতনতার অভাব এবং ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করা। ঢাকা শহরের বহু পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন যুগপ্রাচীন। সেই কবে স্থাপন করা হয়েছে। এরপর জোড়াতালি ছাড়া কার্যত কিছু করা হয়নি। তদুপরি অনেক ক্ষেত্রে লাইনগুলো গায়ে গায়ে লাগানো। ফলে কোনো কারণে দুইটি লাইনের কোনো একটি অংশ ফেটে বা ভেঙে গেলে খাবার পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা মিশে যায়, ৩. অনেক সময় রাস্তার পাশের বাসিন্দা পানি বা সুয়ারেজ লাইন নেওয়ার জন্য লোক নিয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা থাকে অদক্ষ। ফলে কোদাল চালাতে গিয়েও পাইপ ফেটে যায়। খাবার পানির সঙ্গে ময়লা মিশ্রিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, ৪. ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করাও পানি দূষিত হয়ে পড়ার জন্য কম দায়ী নয়। এর ফলে ট্যাংকে শুধু শেওলা জমা হয় না, ইঁদুর-বিড়াল পড়ে ও পচে-গলে পানি দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত করে।

বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন যদি সেই পানি বিশুদ্ধ হয়। এই পানি আমরা কি পাচ্ছি? পানি বিশুদ্ধ না হলে তা হয়ে ওঠে রোগ-ব্যাধি এমনকি মৃত্যুর কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবদেহের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণ পানি। বলা বাহুল্য, দূষিত পানি। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হলে মানুষ ৭৫ শতাংশ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। বিপুল অঙ্কের চিকিত্সা ব্যয় থেকে রেহাই পেতে পারে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, পানির প্রাকৃতিক উত্সকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে। পানি যেখানে সহজপ্রাপ্য হয়েছে, সেখানেই জনবসতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের জন্য পানির অপরিহার্যতা প্রশ্নের অতীত। এককালে পানির প্রাকৃতিক উত্সহসমূহ থেকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির যোগান আসত। এখন সে অবস্থা নেই। নানা কারণে পানির প্রাকৃতিক উেসর সংখ্যা যেমন হ্রাস পাচ্ছে তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির উত্সগুলো দূষণের শিকার হচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্ব জুড়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ফলে সভ্যতা ও বসতির অস্তিত্ব গভীর সংকটে নিপতিত হতে পারে। বিশুদ্ধ পানির নিরাপত্তা গড়ে তোলার পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। এটা আশঙ্কার কথা।

ঢাকায় পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পানির বিকল্প উত্স যেমন সন্ধান ও ব্যবহার করতে হবে তেমনি ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রম আরো বাড়াতে ও গতিশীল করতে হবে। এই মুহূর্তে ঢাকা ওয়াসাকে সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধতা সংরক্ষণে মনোযোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

লেখক : গবেষক