শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সবুজ আন্দোলনের দায়িত্ব নিতে হবে তরুণদের

আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:২২

আলম শাইন

দেশে যুবসম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যার অধিকাংশই শিক্ষার্থী; গণ্ডমূর্খের সংখ্যা তেমন একটা নেই এখন আর। ফলে সমাজের নেতৃত্বেরও পরিবর্তন এসেছে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই যুবারা নেতৃত্বের আসনে বসতে সক্ষম হয়েছেন। এই আসন বাহুবলে দখল করে নেননি তারা; যোগ্যতা ও মেধা খাটিয়েই ছিনিয়ে নিয়েছেন। নেতৃত্ব নিয়ে মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা যে না-ঘটছে তা কিন্তু নয়, সেসব এতই নগণ্য যে তা ধর্তব্যের মধ্যেও পড়ে না। বিপথগামী যুবাদের কথা ভিন্ন, সে সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। বেশিরভাগই ভালোদের তালিকায় পড়ে বলেই আমাদের ধারণা। তার প্রমাণও আমরা বিভিন্ন ঘটনায় বিভিন্নভাবে পেয়েছি। যে কোনো দুর্যোগ কিংবা শুভকাজে প্রথম যুবাদেরই আমরা এগিয়ে যেতে দেখেছি। এমনকি রাজনীতিতেও তারা এগিয়ে আছেন। আর স্বেচ্ছাশ্রমের ক্ষেত্রে যুবাদের তুলনা অতুলনীয়; ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে এমন। সবুজ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও দেখেছি তারা স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহী। গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও, দেশ বাঁচাও—এসবের দিকে তাদের দৃষ্টিপাত আমাদের মোহিত করেছেন। সোজাসাপটা পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আমরা যুবাদের আজকাল নিয়মিত পাচ্ছিও। তারা এখন সোচ্চার হয়েছেন, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে শিখেছেন অর্থাত্ অন্যায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও এগিয়ে আসছেন। জলাশয় সংরক্ষণ, বন্য প্রাণী এবং বন নিধনের প্রতিবাদে দৃষ্টান্ত রাখছেন।

একটা সময় যুবক বলতে আমরা অলস বেকারদেরই বুঝতাম। সে প্রথা তারা ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষাদীক্ষা শেষ করে তারা নিজেরাই উদ্যোগী হচ্ছেন ভালো কিছু করে দেখাতে। অনেকে সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছেন, কেউ-বা পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের বাইরেও। কেউ-বা চাকরিবাকরি জোগাড় করে নিচ্ছেন নিজ যোগ্যতায়। আর যারা দেশে আছেন কিংবা শিক্ষার্থী রয়েছেন তারা অলস সময়টাকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন। ফেসবুকে নিমগ্ন থাকলেও ভালো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন যখন-তখন।

আমরা দেখেছি, কৃষকদের বিপদে যুবক শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছেন। ধান কেটে তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, অর্থ সাশ্রয় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে তারা সামান্য জলও স্পর্শ করেননি। যা রীতিমতো ইতিহাস হয়ে রয়েছে দেশে। বিভিন্ন এলাকায় এডিস নিধনেও তারা সাফল্য দেখিয়েছেন। এছাড়াও ঝোপ-জঙ্গল পয়পরিষ্কারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। গ্রামাঞ্চলের হাজামজা জলাশয় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিষ্কার করছেন বহুকাল ধরেই। তা ছাড়াও যুবাদের স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি আমাদের আকৃষ্ট করেছে। এক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠদের ভূমিকা খুব একটা নজরে পড়ছে না আমাদের। যুবারা যেমন সমাজিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী, তেমনি রয়েছে তাদের আকাশচুম্বী সফলতাও। সুতরাং ভালো কাজে তাদের আরো উজ্জীবিত করতে হবে। যুবারা বখে গেছে—সেটি মাথায় নিলে হবে না, শাসন-সোহাগের মাধ্যমেই দিকনির্দেশনা দেবেন ময়মরুব্বিরা; সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সামাজিক অনাচার তাড়াতে যুবাদের প্রয়োজনীতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসহায়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ছোট্ট একটি উদাহরণ টানতে হচ্ছে, যা আমাদের টনক নাড়িয়েছে খানিকটা। পাশাপাশি বিশ্বাস জন্মেছে যুবাদের প্রতি। সম্প্রতি আমরা খবরের কাগজে দেখেছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে গাছ কাটার বিরুদ্ধে অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানাতে। কোনো ধরনের ভাঙচুর নেই অথচ হূদয়স্পর্শী সেই প্রতিবাদ। কাটা গাছের কাণ্ডে কাফনের কাপড় জড়িয়ে মৌন মিছিল করেছেন তারা। সেই প্রতিবাদ কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে। তারা লজ্জিত হয়েছেন শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডে। মিডিয়ারও দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে অভিনব প্রতিবাদটি।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিশ্বাস বেড়ে গেছে যুবসম্প্রদায়ের ওপরে। সারা দেশে তথা সমগ্র বিশ্বে যেভাবে পরিবেশের ওপর জলুম নির্যাতন করা হচ্ছে তাতে করে এমন দৃঢ়চেতা যুবসম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। যে শক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারলে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাতে থেকে রক্ষা পেতে পারি। বন-বনানী, বন্যপ্রাণী, জলাশয় রক্ষায় যুবাদের আমরা সোচ্চার করে তুলতে পারি। এ ধরনের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে প্রচারমাধ্যমকেও। অন্যদিকে ভালো কাজে তাদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে, তাহলে তারা উদ্বুদ্ধ হবেন। যদি বিষয়টা একবার তাদের মাথায় প্রবেশ করানো যায় যে, এটি তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তাহলে পরিবেশ রক্ষায় যুবসম্প্রদায় অকাশচুম্বী সফলতা দেখাতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।

যুবসম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাশ্রমের আরেকটি উদাহরণ দিতে হচ্ছে আমাদের, যদিও সেটি পাশের দেশের, তথাপি মনে হচ্ছে দৃষ্টান্তটি কাজে লাগতে পারে। সেটি হচ্ছে ভয়ংকর উদ্ভিদ পার্থেনিয়াম নিধন। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার যুবসম্প্রদায় প্রতি সপ্তাহে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিষাক্ত উদ্ভিদ পার্থেনিয়াম নিধন করছেন লবণজল নিক্ষেপ করে। যেহেতু পার্থেনিয়াম আমাদের দেশেও ছড়িয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে আমাদের যুবারাও কাজটি করতে পারেন; যদি আমরা তাদেরকে একটু দিকনির্দেশনা দিই, তাহলে সফল হবেন তারা। এসব সরকারের পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, এটি করতে হবে আমাদেরকে সামাজিক প্রচেষ্টায়। যুবকদের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারলে যেমন পরিবেশ রক্ষা হবে, তেমনি যুবসম্প্রদায় যুবশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। এর ভালো আরেকটি দিক হচ্ছে, পরিবেশ-সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে যেমনি প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখবে, তেমনি জঙ্গিবাদ কিংবা রাহাজানি থেকে সরে আসবে যুবারা।

মনে রাখতে হবে, আমাদের যুবসম্প্রদায় একটি শক্তি; যে শক্তি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং আমরা যেন সেই শক্তিকে কাজে লাগাই; পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে তাদের উদ্বুদ্ধ করি। তাতে করে দেশ বাঁচবে, বাঁচবে পৃথিবীও, সেই সুবাদে আমরাও সুযোগ পেয়ে যাব দীর্ঘসময় সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকার।

n লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট