শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবনার এখনই সময়

আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:১৯

ড. মো. নাছিম আখতার

মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে বৃষ্টিপাত কমছে, বাড়ছে খরা, সৃষ্টি হচ্ছে পানির সংকট। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী পানিসংকটে ভুগবে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে কিংবা নানা বিষাক্ত উপাদানের সংমিশ্রণে পানের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যেদিন সোনার চেয়েও বেশি দামি হবে পানি। পৃথিবীতে যে পানি মজুত আছে তার বেশিরভাগই সমুদ্রের লোনা জল। মোট পানির মাত্র ৩ শতাংশ স্বাদু পানি। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্বাদু পানির চাহিদা বাড়লেও শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপনের কারণে ভূপৃষ্ঠের ওপর রক্ষিত নিরাপদ পানি দূষিত হয়ে পড়ছে এবং এর পরিমাণও সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই একবিংশ শতাব্দীর জন্য স্বাদু পানির মজুতকে আমরা লিকুইড গোল্ড রিজার্ভ হিসেবে ভাবতে পারি।

কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উলটো। নদীমাতৃক এই দেশের নদীগুলো দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। খননের অভাবে অনেক নদীই হারিয়ে গেছে। আবার যেগুলো খনন হচ্ছে সেগুলোও নানা অনিয়মের কারণে দফায় দফায় খনন করেও কোনো সুফল মিলছে না। ২৭ এপ্রিল ২০১৯ একটি জাতীয় দৈনিকে গড়াই নদীর পুনঃখননে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়। খবরে প্রকাশ, গড়াই নদীর নাব্য রক্ষায় ২০ বছর ধরে শুধু টাকার গড়াগড়ি চলেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খনন কাজে ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ব্যয় হলেও গড়াইয়ের বুক জুড়ে শুধু বালুচর। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহত্ উদ্যোগ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল পুনঃখনন। নদী খননের মাধ্যমে নাব্য ফিরিয়ে আনলে অনেক পণ্যই নদীপথে পরিবহন করা সম্ভব। নৌপথগুলো সক্রিয় করলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে। কমবে সড়ক দুর্ঘটনার হার। নদীতে নাব্য থাকলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপত্সীমার নিচে কখনোই নামবে না। নদীর নাব্য ও প্রবাহ সারা বছর ধরে রাখলে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠবে নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান। একবিংশ শতাব্দীর ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে নদী খনন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিকল্পনা ছাড়া নদী রক্ষায় কোনো প্রকল্প নয়।’ পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করলে কোনো ফল হবে না। এতে সরকারের সব টাকা গচ্ছা যাবে। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও সততা নিয়ে কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ‘৫৯ জেলায় ৪৫ হাজার নদী দখলদার চিহ্নিত’। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে বহমান নদীর সংখ্যা ৪০৩টি। জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দিয়ে দখল ঠেকাতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে রায় দেয় উচ্চ আদালত। দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তা প্রকাশ করার নির্দেশও দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নদী রক্ষা কমিশন ৫৯ জেলায় ৪৫ হাজার ১৪৮ দখলদারের তালিকা প্রস্তুত করে। এতে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিকের নাম। বর্তমান সরকার নদীগুলোকে দখলমুক্ত করার যে নজীরবিহীন উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। উন্নয়ন দরকার কিন্তু উন্নয়নের নামে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করা বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ নয়। কিন্তু আমরা মানুষ এই ভুল বারবার করে যাচ্ছি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন জঙ্গলে ২০১৯ সালে অতিমাত্রায় আগুন লাগছে। এর মূলে রয়েছে মানুষের দুর্নিবার অর্থনৈতিক লোভ। গহিন আমাজন জঙ্গলে অবৈধভাবে সোনা খুঁজতে গিয়ে একদল বারবার আগুন লাগাচ্ছে। আরেক দল পৃথিবীর গোমাংসের সরবরাহ বাড়াতে গোচারণভূমি বৃদ্ধিতে বন ধ্বংস করছে। যারা সোনা খোঁজার কাজে আছে তারা সোনা বিক্রি করে ঐ অর্থ মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অনৈতিক পথে খরচ করছে। বাস্তবিকপক্ষে মানুষ তার নিতান্ত প্রয়োজনে নয়, ভোগ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্থের জোগান দিতে এইভাবে নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। মানুষের ভোগের বলি কিন্তু বিশালাকার সমুদ্রও। অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিক ও পলিথিন সামগ্রী ব্যবহারের জন্য পৃথিবীর ধমনিখ্যাত সমুদ্রগুলো আজ দূষণের কবলে। পলিথিন পাকস্থলীতে জমে মারা যাচ্ছে বিশালাকার তিমি। আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ ও বালু নদের পানি যারপরনাই দূষিত। শুকনো মৌসুমে সেচকাজে ব্যবহারের জন্যও নিরাপদ নয়। আবার বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমেছে পলিথিন সামগ্রীর কয়েক ফুট আস্তরণ, যা কয়েক শ বছরেও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জাতীয় দৈনিকের একটি খবরের শিরোনাম ‘ক্লান্ত হয়ে পড়ছে পৃথিবী!’ খবরে প্রকাশ আজকের পৃথিবী যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছে তার জোগান দিতে কার্যত ১ দশমিক ৭টি পৃথিবী দরকার। আর যদি আলাদা-আলাদাভাবে অঞ্চলের কথা চিন্তা করি, তাহলে জার্মানরা যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, সেভাবে গোটা বিশ্বের মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করলে তাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হতো তিনটির বেশি পৃথিবী। মার্কিনিদের ক্ষেত্রে এটি ৪ দশমিক ৯টি পৃথিবীর সমান। বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ সচেতনতা আন্দোলন জোরদার হয়েছে। এর পরেও পরিসংখ্যান মতে বিশ্ব প্রতি বছর ৩৩ লাখ হেক্টর বন হারাচ্ছে। ফলে বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয় ও অনাবৃষ্টি। এমন প্রতিকূল অবস্থায় সময় থাকতেই জলাধার, তথা নদনদী, খাল-বিলগুলোকে খনন করা সময়ের দাবি মাত্র। পানি দূষণরোধে আমাদের সবাইকে হতে হবে সোচ্চার ও আন্তরিক। নতুবা ১৬ কোটি মানুষের জীবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে—থেমে যেতে পারে তাদের জীবনস্পন্দন। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাববার এখনই সময়; অন্যথায় একবিংশ শতাব্দীর ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নত দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

n লেখক :অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০৭