বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিরাপদ ক্যাম্পাসের সন্ধানে

আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৮

ড. এম এ মাননান

যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি, ১৯৭৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত, তখনো আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বুঝতে শুরু করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতে বসবাস করায় হাজারো বিড়ম্বনা। ছাত্রাবস্থায়ও দেখেছি, পানির সঙ্গে ডাল মেশানো খাবার (নাকি ডালের সঙ্গে মেশানো পানি) থেকে শুরু করে পাকি সরকারের মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনী এবং ছাত্রনামধারী দুর্বৃত্তের কবলে ছিল হলগুলো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভালোমন্দ দেখার মতো সুদক্ষ কর্তৃপক্ষ কোনোকালেই ছিল বলে মনে হয় না, দুই একটা হাতেগোনা ব্যতিক্রম ছাড়া। ঐসব দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় কম হলেও প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় বা অদক্ষতায় কিংবা গরজহীনতায় এরা ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরশাদী আমলে তো হলগুলো হয়ে উঠেছিল এক একটা ‘গুন্ডানিবাস’। একবার তো নিজের আসল মতলব আড়ালে নেওয়ার প্রচেষ্টায় একজন শিক্ষামন্ত্রী (আমার নিজের এলাকার এমপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সভায় বলেই বসলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকাতের গ্রাম।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়ার কারণে ঐ সভায় উপস্থিত থাকায় তার এ বক্তব্যটি শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। তার এ অর্বাচীন বক্তব্যে সবাই হতবাক কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—কেউ কিছু বলছিলেন না, শুধু শুনেই যাচ্ছিলেন। সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করে মন্ত্রীকে বললাম: ‘আপনার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আপনার মতো ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা যদি সাহায্য না করেন তাহলে সেনানিবাসে থাকা যুদ্ধাস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে কী করে? আর কী করেই-বা ডাকাতের গ্রাম হয়। সভায় উপস্থিত সবাই সব শুনলেন-দেখলেন, কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মন্ত্রী নিজেই কথা না বাড়িয়ে বসে পড়লেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও বসা ছিলেন মন্ত্রীর বাম পাশে। সভায় অনেক সচিব, প্রাক্তন সচিবসহ কয়েকজন সাবেক উপাচার্যও ছিলেন। সভাশেষে অনেকেই চা খাওয়ার সময় ‘আপনি সঠিক কাজটিই করেছেন’ বললেও নিজেরা যে ব্যক্তিত্বহীনতার কাজটি করলেন তা একটুও ভেবে দেখলেন না। এভাবেই সমাজে মন্দমনের মানুষদের দাপট বেড়ে যায় আর সুমনা মানুষরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, আবাসিক হলগুলোতে যদি প্রশাসন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, উপাচার্য পেছনে থেকে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন আর রাষ্ট্রযন্ত্র প্রশাসনের সঙ্গে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে একটা আবাসিক হলে/হোস্টেলে মদের আসর বসতে পারে না, কোনো কক্ষকে ‘টর্চার সেল’ কেউ বানাতে পারে না কিংবা সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে মাস্তানি করার সুযোগ পায় না।

বুয়েটের যে হলে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। পত্রিকায় দেখলাম, সেখানে অনেক আগে থেকেই ছিল টর্চার রুম আর মদের আড্ডার প্রচলন। হল প্রশাসন নিয়মিত রুম পরিদর্শন করলে, খবরাখবর নিলে, আবাসিক ছাত্রদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মতবিনিময় সভায় একত্রিত হলে এবং হল গেটে অভিযোগ বাক্স রাখার ব্যবস্থা করা হলে, দুর্বৃত্তপনা করার মতো সুযোগই কেউ পেত না। মাসে প্রভোস্ট অন্তত দুবার এবং উপাচার্য একবার হল ঘুরে ঘুরে দেখলে (যাকে ম্যানেজমেন্টের ভাষায় বলা হয় ‘ম্যানেজমেন্ট বাই ওয়ান্ডারিং এরাউন্ড’), আবাসিক ছাত্ররা যারা মা-বাবাকে ছেড়ে গ্রামগঞ্জ থেকে এসে হলে নিরানন্দ জীবনের একটি ঘাসহীন মাঠে বসবাস করে, তারা কিছুটা হলেও মনে করতে পারে যে, তারা অভিভাবকহীন নয়। বাস্তবে চিত্রটা উলটো কেন? ভেবে কোনো কারণ পাই না। আমি চার বছর জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট ছিলাম অনেক বছর আগে, ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত। প্রতি সপ্তাহে রুটিন করে একবার রাত ১১টার দিকে হলের প্রতিটি করিডোরে ঘুরে আসতাম, দৈবচয়ন ভিত্তিতে কয়েকটা রুমে দরজায় টোকা দিয়ে ছাত্রের অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়তাম, কথা বলতাম, তার কোনো অসুবিধা আছে কি না তা জানার চেষ্টা করতাম, মতামত শুনতাম এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম। সঙ্গে থাকতেন একদল চৌকস হাউজ টিউটর। তারা রোল কল করতেন প্রত্যেক রুমে গিয়ে। একবার তো তিন তলায় গিয়ে দেখি, ৮/১০টা রুম দখল করে আছে কয়েকজন ‘বিগত’ ছাত্রনেতা যারা বিভিন্ন অফিসে চাকরি করে, দুই একজন নিউমার্কেট-নীলক্ষেত এলাকায় গুন্ডামি করে টাকা রোজগার করে (শোনা অভিযোগ)। সব হাউজ টিউটরকে নিয়ে সবগুলো রুম থেকে খাট-লেপ-তোষক বের করে পাশের পুকুরে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম তাত্ক্ষণিকভাবে। জানতাম প্রতিক্রিয়া হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের ‘বন্ধু মাস্তানরা’ হাজির। প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে শুরু হম্বিতম্বি। নেতা গোছের যেটা ওটাকে কলার ধরে যখন বললাম, তুমি তো এ হলের কেউ নও; এখানে রাত সাড়ে ১২টায় এসেছো কেন? সদম্ভ জবাব: প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে যে কোনো হলে যে কোনো সময় ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন। কলার ছেড়ে দিয়ে তার বাম হাত ধরে যখন বললাম: চলো, কোন প্রধানমন্ত্রী তোমাকে এরকম অনুমতি দিয়েছেন তা তার সামনে গিয়েই জানব। হাত ধরে টানতে টানতে গেট পর্যন্ত আসার পর যখন গাড়িতে উঠতে যাব তখনই সুর পালটে গেল। ক্ষমা চেয়ে চলে গেল। আর কখনো তাদেরকে দেখিনি। এসব উটকো ঝামেলা সময়মতো মোকাবিলা করা না হলে দুর্বৃত্তরা পেয়ে বসে। আমার সঙ্গে থাকা সিনিয়র হাউজ টিউটরগণও সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রভোস্ট হিসেবে আমার দৃঢ়তা দেখে তারাও উত্সাহিত হয়েছিলেন। সে হাউজ টিউটররা এখন অনেক সম্মানজনক বড়ো পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করছেন। তারা হলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রোভিসি, প্রক্টর এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি যথাক্রমে কবি ড. মোহাম্মদ সামাদ, ড. গোলাম রাব্বানী এবং ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন। প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটররা দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করলে হলগুলো দুর্বৃত্তমুক্ত করা কোনো ব্যাপারই নয়।

দেশে যা কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে তার দায়ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর। অবস্থাটা এমন, সবকিছু তাকেই দেখতে হয়, সবকিছু তাকেই সমাধান করতে হয়। যদি এমনটাই চলতে থাকে তাহলে দায়িত্ব গ্রহণ করে যারা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন তাদের থাকার দরকারটা কী? জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাদেরকে পোষার দরকার কেন? তারপরও বিশাল হূদয়ের মানুষটি রাগ করেন না। বাবার মতো সমগ্র অন্তর দিয়ে মমতাভরে দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। যেমনটি নিয়েছেন ইদানীংকালের অনেক ক্ষেত্রে : সোনাগাজীর কুলাঙ্গার মাদ্রাসা অধ্যক্ষের হাতে ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারা ; বরগুনায় প্রকাশ্যে মিন্নির স্বামীকে কুপিয়ে খুন ; ছাত্রলীগ-যুবলীগের বেপরোয়া কিছু কর্মকাণ্ড এবং ক্যাসিনোবাজদের ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপ যা পেয়েছে দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন। তিনি শুরু করেছেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান। বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নং কক্ষে ৬ অক্টোবর রবিবার রাতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামধারী ছাত্রনেতা তকমা লাগানো ১৯-২০ জন দুর্বৃত্তের পিটুনিতে নিহত কুষ্টিয়ার মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে প্রশাসন রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি, কিন্তু এগিয়ে এসেছেন জননেত্রী, মমতায় ভরা সেই প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তাকে আসতেই হলো। হলের প্রভোস্ট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সময়মতো আসেননি। এ ব্যর্থতার লজ্জা তারা রাখবেন কোথায়? খবরে দেখলাম প্রায় ৪১ ঘণ্টা পর প্রকাশ্যে এসে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। উপাচার্য আর প্রভোস্টের ব্যর্থতা একেবারেই অমার্জনীয়। ভরসা পাচ্ছি এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা অভাবনীয় ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন যা তার কয়েকটি ঘোষণা এবং কার্যক্রম থেকে স্পষ্ট। তিনি ঘোষণা করেছেন :‘আবরারের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কে কোন দল, কী করে না করে, আমি সেটা দেখি না। আমার কাছে অপরাধী অপরাধীই’ (যুগান্তর, ১০ অক্টোবর ২০১৯)। তিনি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর হলে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়, তিনি সবকিছুর খবর রাখেন, কারণ তিনি দেশটাকে অনেক ভালোবাসেন, দেশবাসীর কল্যাণের কথা ভাবেন, দেশটাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে চান আর চান সবাই মিলে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা তিনি শক্ত হাতে নির্মূল করবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন এক পর্যায়ে পৌঁছুবে যেখানে কোনো গোষ্ঠীর কাছে শিক্ষাঙ্গন জিম্মি হয়ে থাকবে না, গণরুম আর র্যাগিং নামক নারকীয় প্রথা চিরকালের জন্য জাদুঘরে চলে যাবে, আবাসিক হলগুলো হবে শিক্ষার্থীদের ‘আপন ঘর’ যেখানে থাকবে একটি বড়োসড়ো লাইব্রেরি যাতে রাত-বিরাতে সবাই লেখাপড়া করতে পারে, থাকবে জিমন্যাসিয়াম আর সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য উপযুক্ত অডিটরিয়াম, গেস্টরুম থাকবে না কোনো দুর্বৃত্তের কবলে, আবাসিক শিক্ষকরা প্রতি রাতে নিয়মিত ছাত্রদের চলাফেরা মনিটরিং করার পাশাপাশি শিক্ষণীয় কাজে সহযোগিতা করবেন, প্রভোস্ট করবেন অভিভাবকের দায়িত্ব পালন, সর্বোপরি উপাচার্য মাথার ওপরে থেকে একটি প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়মিত সবকিছু মনিটরিং করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় যেন অবশ্যই হয়ে ওঠে সত্যিকারের জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ আর সৃজনশীল মুক্তবুদ্ধি চর্চার আদর্শ স্থান। থাকবে এমন পরিবেশ যেখান থেকে আপনা-আপনি সৃষ্টি হবে ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব। ছাত্র রাজনীতি থাকবে শুধু শিক্ষার্থীদের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে, কোনো প্রকার মাতব্বরি করার জন্য নয়, যেমনটি ছিল ষাটের দশকে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশা করা কী অনেক কিছু চাওয়া? আমরা চাইলে সবকিছু পারি। বাঙালি পারে না এমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন শুধু সত্ মানসিকতা, মানবিক মন, ভালো কিছু করার তাগিদ আর সর্বোপরি অপরের প্রতি নির্মল ভালোবাসা।

n  লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়