মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব

দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৪৩

গত এক দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার উন্নয়নে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পূর্ণবিকশিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর দু্ই দেশের অংশীদারিত্বকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। পৃথিবীর যে কোনো দুই প্রতিবেশি দেশের সম্পর্কোন্নয়নে তা রোল মডেল স্বরূপ। বাংলাদেশ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবে। ২০২১ সালে পালন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই প্রেক্ষিতে এই সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সেই ভিশনের ভিত্তিমূল রচনা করেছে। দুই দেশের গভীর সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় আশাবাদেরও বাতাবরণ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের পক্ষ থেকে এক যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।  সেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য একে অপরের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসা করা হয়েছে বন্দর ব্যবহার, কানেকটিভিটি, পানি বিনিময়, বিদ্যুত্, গ্যাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার রূপরেখা প্রণয়নের জন্যও। বিশেষ করে, বলপূর্বক বিতাড়িত ও বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে তিনটি দ্বিপাক্ষিক প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে এবং স্বাক্ষরিত হয়েছে এমওইউসহ সাতটি চুক্তি। প্রকল্পগুলো হলো— বাংলাদেশ থেকে এলপিজি আমদানি, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বিবেকানন্দ ভবন নির্মাণ এবং খুলনার ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বাংলাদেশ-ভারত পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট স্থাপন। অন্যদিকে সমঝোতা চুক্তিগুলো হলো— ভারতে ও ভারত থেকে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস), সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচির নবায়ন ও বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে নজরদারি (কোস্টাল সারভেইলেন্স সিস্টেম)। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কানেকটিভিটির জন্য এই দুই বন্দর ব্যবহার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যসমূহে এলপিজি আমদানি বাংলাদেশের প্রচুর রাজস্ব আহরণে সহায়ক হবে। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ককে শক্তিশালী করল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক কানেকটিভিটির আরো উন্নতি সাধন করল।

নয়াদিল্লি ও ঢাকা উভয়েই বঙ্গোপসাগরীয় এলাকাকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য কানেকটিভিটি ও সম্পদের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করতে আগ্রহী। আঞ্চলিক বাজার সংহতকরণ, সীমান্ত অঞ্চলে পণ্য পরিবহণ এবং সেবা ও জনগণের অবাধ প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার অবসানের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা যায়। ভারত বাংলাদেশকে তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত করতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। স্থল হোক আর সমুদ্র হোক, মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য নয়াদিল্লির কানেকটিভিটি পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে বাংলাদেশে তার ট্রানজিট অধিকার আদায় ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর।

ভারত ও বাংলাদেশ এখন সুপ্রতিবেশীসুলভ ব্যবহারের জন্য আদর্শ স্বরূপ। বাংলাদেশে তরুণদের প্রশিক্ষণে দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করা হয়েছে তা পারস্পরিক সুফল লাভের আরেকটি নজির। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলির তালিকা থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অব্যাহতভাবে অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কের কারণে দুই দেশই লাভবান হবে। নয়াদিল্লিকে এই সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, যাতে উভয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় ও স্থিতিশীল উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত যারপরনাই খুশি। স্পষ্টত ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আজ বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। দুই দেশের নেতৃত্বের সহযোগিতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে আজ বিদ্যুত্-চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশেরও বেশি ধরা হয়েছে। এই দেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে। ২০১৮ সালে এই দেশের রপ্তানি ছিল ৬.৭ শতাংশ। বর্তমানে তা ১০.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণা পরিবর্তনের এটাই সময়। বাংলাদেশ এখন আর ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষকবলিত দেশ নয়। বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণে দক্ষিণ এশিয়ার ইঞ্জিন। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসামের নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে যে আশ্বাস দিয়েছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ভালো করছে বিধায় ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের উচিত এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।

সীমান্ত এলাকায় ভারতের বিরুদ্ধে যে নিরাপত্তাগত হুমকি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার ঝুঁকি ছিল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার মূলোত্পাটন করেছে। আজ ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ সীমান্তের অন্যতম। সীমান্তে হত্যা হ্রাস পেয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সুসম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

২০১৫ সালের ‘ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা স্থল সীমান্ত চুক্তি এই সম্পর্কের মাইলফলক। এর ফলে দুই প্রতিবেশী দেশ দীর্ঘদিনের অনেক সমস্যার সমাধান করে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সর্ববৃহত্ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে গত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৪২.৯১ ভাগ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানি করে। এতে ভারতের বিদ্যুত্ রপ্তানি আরো ৫০০ মেগাওয়াট বেড়েছে। এছাড়া দুই দেশের বিদ্যুত্ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুেকন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।

বিমানের চেয়ে স্থলপথে ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শতকরা ৮৫ ভাগ বাংলাদেশি এখন স্থলপথেই ভারত যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ঢাকা-কলকাতা ও কলকাতা-খুলনা ট্রেন যোগাযোগও ভালো চলছে। অন্যদিকে আগরতলা-আখাউড়া রেল যোগাযোগ নির্মাণাধীন। ২০১৮ সালে অতিরিক্ত পাঁচটি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এ বছর মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো ঢাকা-কলকাতা নৌপথে যোগাযোগও উদ্বোধন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে যত পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেছেন তার ২১.৬ শতাংশ বাংলাদেশি। তার মধ্যে ৮৩.৭ শতাংশ প্রকৃত পর্যটক এবং ১০.২৮ শতাংশ চিকিত্সার জন্য ভারত গিয়েছেন। আজ ভারতের স্বাস্থ্য পর্যটন রাজস্বে বাংলাদেশের অবদান ৫০ শতাংশ।

ভারত ও বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসেফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (আপটা), সার্ক প্রিফারেন্টাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (সাপটা) ও অ্যাগ্রিমেন্ট অন সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা)-এর সদস্য। ভারত অ্যালকোহল ও তামাক ছাড়া বাংলাদেশি সকল পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। স্থানীয় নাগরিকদের সুবিধার্থে চারটি সীমান্ত হাট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। অতিরিক্ত ১০টি সীমান্ত হাট প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও বাস্তবায়নাধীন। ভারত থেকে বাংলাদেশে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই দ্বিগুণেরও বেশি এসেছে। ২০১৪ সালে এটা ছিল ২৪৩.৯১ মিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৬৭০.১১ মিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি। দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন এবং বাংলাদেশে তাদের আরো বিনিয়োগ কামনা করেছেন।

ভারত ও বাংলাদেশ একই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, ইতিহাস ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনের অধিকারী। এটা দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করে। শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনটি ‘সি’-কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে তা হলো—কোঅপারেশন (সহযোগিতা), কো-অর্ডিনেশন (সমন্বয়) ও কনসোলিডেশন (সুদৃঢ়করণ)।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : ফাইজুল ইসলাম

n লেখক : ইত্তেফাকের নয়াদিল্লি প্রতিনিধি