মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৯

খন্দকার মাহবুব হোসেন

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে প্র্রতি বছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালিত হয়। সাদাছড়ি হাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে পথচলায় সাহায্য প্রদানে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে নিরাপদে পথ চলতে পারে, সেদিকে যানবাহনের চালকদের সচেতন করা দিবসটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আমাদের দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। একজন শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল মানুষ কেবল দৃষ্টিহীনতার কারণে তার পরিবারের, সমাজের তথা রাষ্ট্রের বোঝাস্বরূপ। তাই দৃষ্টিহীনতা আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা।

আধুনিক চিকিত্সা দ্বারা আজকাল দৃষ্টিহীনতা নিবারণ সহজসাধ্য হয়েছে। চিকিত্সা দ্বারা যাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, তাদের যদি উপযোগী শিক্ষা বা কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে সে একজন স্বাবলম্বী নাগরিক হিসেবে সমাজে স্থান করে নিতে পারে।

বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তি দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। এছাড়া প্রতি বছর কয়েক হাজার ব্যক্তি বিভিন্ন চক্ষুরোগে সুচিকিত্সার অভাবে দৃষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছে। পুষ্টিহীনতার কারণে দৃষ্টিহীনতার কবলে পড়ছে অগণিত শিশু।

এদিক থেকে ‘বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস’ আমাদের দেশে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিভিন্ন উন্নত দেশে দৃষ্টিহীনদের স্বাধীনভাবে চলাচলের ক্ষেত্রে সাদাছড়ির ব্যবহার বিশেষ অবদান রাখছে। আমাদের দেশেও ইদানীং অন্ধজনদের মধ্যে সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশের মতো সাদাছড়ি হাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যাতে নিরাপত্তাসহ চলাফেরা করতে পারে, আমাদের দেশেও সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে তার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাফিক আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিহন বিভাগ প্রতিবন্ধীদের বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

আমাদের দেশে যারা দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে, তাদের অনেকেরই দৃষ্টিশক্তি আধুনিক চিকিত্সার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কেননা, দেখা গেছে যে এদের বেশির ভাগ ‘ছানিরোগের’ কারণে দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। এই রোগ অতি সহজে অস্ত্রোপচারের দ্বারা নিরাময় করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই সাধারণ চিকিত্সাব্যবস্থা থেকেও এদেশের দরিদ্র জনগণ বঞ্চিত। এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করা এককভাবে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এজাতীয় সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন  সেবামূলক  সংস্থা  এর  সমাধানে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অন্ধ কল্যাণ সংস্থা সাইট সেভার্সের সহযোগিতায় ঢাকার মিরপুরে সমিতি পরিচালিত ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন চক্ষু হাসপাতাল, ঢাকা’য় বিনা মূল্যে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র চক্ষুরোগীকে উন্নত মানের অস্ত্রোপচার দ্বারা দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে ‘ছানিরোগের’ কারণে যে হারে গ্রাম পর্যায়ে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে অবিলম্বে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে এর চিকিত্সার ব্যবস্থা না করলে এক ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি পুষ্টিহীনতার হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য ব্যাপক হারে ভিটামিন ‘এ’ বিতরণ করছে এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চক্ষুরোগ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে তাদের চক্ষু পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করছে। ইতিমধ্যে কয়েক লাখ স্কুলশিক্ষার্থীর চক্ষু পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিত্সার দ্বারা যাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তাদের বিশেষ পদ্ধতিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনক্ষম নাগরিকরূপে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে দৃষ্টিহীনদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে ‘অন্ধ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি। এখানে দৃষ্টিহীনদের টেলিফোন অপারেটর ও কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির আর্থিক সহায়তায় বেশ কিছু দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রী ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করছে এবং এদের অনেকে  সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে অবতীর্ণ হয়েছে।

সরকার দৃষ্টিহীনসহ প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা প্রবর্তন করেছে; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন নেই। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। দৃষ্টিহীনসহ সব শিক্ষিত প্রতিবন্ধীকে কর্মস্থানের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। কিছুসংখ্যক দৃষ্টিহীনসহ শারীরিক প্রতিবন্ধী যে ন্যক্কারজনকভাবে ঢাকা শহরের রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করে তা শুধু একটি সভ্যসমাজের জন্য অপমানজনক নয়, মানবতাবিরোধীও বটে। তাই এই ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। এই সব অসহায় প্রতিবন্ধীর ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এদের অনেককে উপযুক্ত কারিগরি প্রতিষ্ঠান দিয়ে উপজর্নক্ষম করাও সম্ভব। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি তাদের এ ব্যাপারে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারকে সহযোগিতা করতেও ইচ্ছুক।

দৃষ্টিহীনতা মানবজীবনে এক ভয়াবহ অভিশাপ। দেশবাসীকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখার সব প্রচেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষ্যে আমরা যদি দেশের অসহায় দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের সেবায় আরো অধিকতরভাবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারি, তাহলেই এ দিনটা পালন সর্বতোভাবে সার্থক হবে।

n লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ

জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি।