মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পুতিনের রাজনৈতিক অবতারবাদ

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৯

মাহবুব মাসুম

১৯৯৯ সালে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ও অবিসংবাদিত অবস্থানে নিয়েছেন। দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী আর তিন মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন শেষে চতুর্থ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই দীর্ঘ দুই দশকে তিনি ভেঙে পড়া রাশিয়ার অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়াকে আবার পরাশক্তির অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। রক্ষণশীল রাশিয়ান সমাজের আদর্শ ব্যবহার করে রাশিয়ার রাজনীতিতে পুতিন নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক কাঠামো আর গণমাধ্যম ব্যবহার করে পুতিন নিজেকে নিয়ে গেছেন অবতারের স্থানে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার সাংগঠনিক কাঠামো প্রায় পুরোটাই ভেঙে পড়েছিল। সোভিয়েত আমলে কেজিবিতে কাজ করা পুতিন প্রেসিডেন্ট হয়ে পুরো কাঠামোটাকে তার নিজের মতো করে সাজান। রাশিয়ার সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এই কাঠামোকে বলা হচ্ছে ‘পুতিন প্রজেক্ট’। এ ধরনের প্যারোকিয়াল কাঠামো গড়ে তুলতে আমলাতন্ত্র আর সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পুতিনের আজকের এই সমষ্টির ঊর্ধ্বে এক ব্যক্তির শাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জনগণের কাছাকাছি যেতে পারা, তাদের আদর্শকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন করতে পারা। প্রথাগত কোনো আদর্শ লালন না করে পুতিন রাশিয়ার জনগণের বিশ্বাস, নিজস্ব কৃষ্টি ও রক্ষণশীলতাকে ধারণ করে দেশ শাসন করছেন। এর পাশাপাশি রাশিয়ার অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানো, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন করা, রাশিয়াকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানে নিয়ে যাওয়াসহ তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে তিনি রাশিয়ার জনগণের কাছে দোষ ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন।

রাশিয়া বিশাল ভূখণ্ডের দেশ হওয়ায় সেখানে বৈচিত্র্য ও আদর্শগত ফারাক থাকাটাই স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো বিভিন্ন দল থাকলেও পুতিনের সময়ে এদের কেউ তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ডুমায় শুধু নিজের পছন্দের লোকদের বসিয়ে পুতিন রাশিয়ায় ‘ম্যানেজড ডেমোক্রেসি বা কারসাজিমূলক গণতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পুতিনের ইচ্ছাই শেষ কথা।

পুতিনের ব্যক্তিত্বও তাকে অবতারের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুতিন নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণের পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও নিজেকে বিকল্পহীন অবস্থায় নিয়ে গেছেন। সিরিয়া, ইরান, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ইস্যুতে রাশিয়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে পুতিনের উত্তরসূরি হিসেবে অনেকের নাম আলোচিত হলেও পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। পুতিনের সময়ে রাশিয়ার সাইবার সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন, ক্রোয়েশিয়া এমনকি ফ্রান্স-জার্মানির নির্বাচনেও কারসাজির কথা শোনা যায়। সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত করে পুতিন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে গড়ে ৮০ ভাগেরও বেশি নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা উপভোগ করছেন।

গণমাধ্যমও পুতিনের শাসনামলকে মসৃণ করতে অবদান রাখছে। রাশিয়ার শতকরা ৫১ ভাগ মানুষের কাছে টেলিভিশনই তথ্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। পুতিন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে পুতিনবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করছেন। জনগণের কাছে সেই তথ্যই পৌঁছাচ্ছে, যা পুতিন চাইছেন।

পুতিন নিজেকে রাশিয়ায় যে অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে নিয়ে গেছেন, তার পেছনে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, নিজের ব্যক্তিত্ব  আর গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পুতিনকে সামনে রেখে এই স্টেক হোল্ডার গ্রুপগুলোও নিজেদের ইন্টারেস্ট বুঝে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ক্রেমলিনের কেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছেন পুতিন। দুই দশকের শাসনে বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন করে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে করে ফেলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বীশূন্য। এটিই অবতারবাদ।

অবতারবাদে পুরো দেশ এক ব্যক্তির শাসনে চলে বলে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এর ফলাফল কী? কী হয় যখন সেই ব্যক্তি কাঠামো থেকে সরে যান?  অবতারবাদে যখন সেই এক ব্যক্তি কোনো কারণে সরে যান বা অপসারিত হন, তখন পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে, দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। রাশিয়ায় পুতিনের হাতে এখনো নিজের উত্তরসূরি নির্বাচনের সুযোগ আছে, যিনি হয়তো পুতিনের তৈরি প্রজেক্টকে সামনে নিয়ে যাবেন এবং স্টেক হোল্ডার গ্রুপগুলোকে সার্ভ করবেন। তবে সেটা পুতিন করতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

n  লেখক :শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়