মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঢাকার বানর অস্তিত্বসংকটে

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ২০:৫৮

দীপংকর গৌতম

১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবাদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক ঢাকা মোগল বাংলার রাজধানী হিসেবে মনোনীত হয়। অনেকেই মনে করেন সুবাদার ইসলাম খাঁর আমলেই ঢাকার নামকরণ ‘ঢাকা’ করা হয়। ঢাকার সুবাদার হয়ে ইসলাম খাঁ এ অঞ্চলের নাম রেখেছিলেন দিল্লিশ্বর জাহাঙ্গীরের নামের আদ্যক্ষরে জাহাঙ্গীরনগর। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা শহরের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আরো অনেক কিংবদন্তি। এরকম একটি দুর্বল কিংবদন্তির উল্লেখ করা যেতে পারে।

তত্কালীন হিন্দুধর্মাবলম্বী একাংশের মধ্যে বৃক্ষপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকবৃক্ষ নামের এমন একটি বৃক্ষকে নাকি হিন্দুরা পূজা-অর্চনা করত। আর এই বিশেষ বৃক্ষ থেকে ‘ঢাকা’ নামের উত্পত্তি। তুলনামূলকভাবে এ কিংবদন্তি কিছুটা অবিশ্বাসযোগ্য। তবে অনেকের মতে, শুধু ঢাকবৃক্ষই নয় পুরো অঞ্চলটি ছিল বিভিন্ন ধরনের গাছ দিয়ে সবুজে ঢাকা। যার কারণে এ এলাকাটির নাম হয়ে যায় ঢাকা।

 এ লেখা মূলত ঢাকার ইতিহাস জানার জন্য নয়। ঢাকায় তখন প্রচুর গাছপালা ছিল। গাছপালা, খাল, নদীঘেরা এ শহরে অনেক প্রাণীর বাস ছিলো সংগত কারণেই। অন্যান্য জীবজন্তুর মতো এখানে বানরের আধিক্য ছিল। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায়, বানর ঢাকার আদি প্রাণী। পুরান ঢাকার পাড়াপড়শিরা বানরকে খাবার ছড়িয়ে দিয়ে নিবৃত্ত করত। বানরকে পুরান ঢাকার মানুষ ভালোবাসত এটা ঠিক, তবে তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের একদল মানুষ যারা রামভক্ত ছিল, তারা বানরকে রামের সখা মনে করে অনেক যত্ন করত। তাদের বাসায় বানর ঢুকে সব খেলেও তারা রাগ করত না। বরং বানর দলের দিকে তাকিয়ে প্রণাম জানাত। গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে পুরান ঢাকা। বানরদের আবাস ধ্বংস হচ্ছে। আগের মতো বানর নেই। স্বাধীনতার পরেও মন্দির, ট্রাস্ট বা ব্যক্তি উদ্যোগে বানরসহ বিভিন্ন জীবজন্তুকে খাবার দেওয়া বা লালন করার রীতি ছিল। মানুষ আরো মানবিক ছিল। এখন বড়ো বড়ো ভবন হয়েছে। প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে। কিন্তু এত অমানবিক, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এরা অনেক সময় বানর মেরে জানালা দিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলেছে, এমন অনেক নজির আছে। এরা পুরান ঢাকায় বাইরে থেকে এসেছে। পুরান ঢাকার হিন্দু-মুসলমানের একটা সংস্কৃতি আছে। এরা পশু, পাখি বা ভিখারিকে ফেরায় না, নিরন্ন মানুষ খেতে চাইলে নিজের খাবারটুকু হলেও দিতে চেষ্টা করে। এটা পুরান ঢাকার রেওয়াজ। কিন্তু হালে এটা আর থাকছে না। নতুন লোকজন এসে ভরে ফেলছে পুরান ঢাকা। বানর এখন কয়েকটি এলাকায় মাত্র টিকে আছে। মৈশুন্ডি ও গেন্ডারিয়া হলো বানরের রাজধানী। এছাড়া সবখানেই একটা-দুটো দেখা যায়।

পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন পেরিয়ে বেশ কিছুদূর হেঁটে মৈশুন্ডি ভগবতী মন্দির। পুরোনো ভবনের আধিক্য এখানে বেশি। পুরোনো ইটের ঘ্রাণ আর সুরকির দেওয়াল দিয়ে বানরের বাঁদরামি দেখতে দেখতে ক্যামেরা ঠিক করছিলাম। এর মধ্যে চোখে পড়ল একদল নারী পুরুষ ছুটছে বানরের পেছনে। নতুন দুটি শাড়ি বাসা থেকে নিয়ে এসেছে বানর। এখন সে এ ডালে ও ডালে শাড়ি নিয়ে ছুটছে। সবাই বলছে মধু দিয়ে দে, মধু দিয়ে দে (বানরকে আদর করে মধু ডাকে)। অনেক দূর লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে হাতে রাখা বানর বেশ কিছুক্ষণ পরে নাগালের কাছে এসে বসে। আমি ছবি তুলতে গেলে মহিলা খুব বিনয়ের সঙ্গে ছবি তুলতে নিষেধ করে। তার ধারণা, ক্যামেরা দেখলে বানরটা ভয় পেয়ে দূরে সরে যাবে, তার কাপড় আর পাওয়া যাবে না । মহিলার নতুন কাপড়ের কী হবে তা ভাবতেও পারছে না। আমি ছবি তোলা থেকে বিরত হই। এরপরে মহিলা কলা-বিস্কুট বানরটার কাছাকাছি রেখে একটু দূরে যায়। সবাইকে সরে যেতে বলে। সবাই দূরে সরে যায়, বানর কাপড় ফেলে রেখে খাবার নিয়ে ছুটে পালায়।

ঢাকা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বানরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পুরান ঢাকায় পাঁচ বছর আগেও যে পরিমাণ বানরের স্বর্গরাজ্য ছিল পুরান ঢাকায় এখন তা আর নেই। বানরের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে; খাবার আর থাকার জায়গার অভাব, সেই সঙ্গে মানুষের বৈরী আচরণে পুরান ঢাকার বানরেরা এখন সংকটে।

জানা গেছে, খাদ্যসংকটের কারণে বিভিন্ন বাসাবাড়ি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দোকানে হামলা করে বানরগুলো। কলা, রুটি কিংবা ভাতের ভাণ্ড নিয়ে ছাদে চলে যায় তারা। আবার খাবার না পেয়ে অনেক সময় কামড় দেয় মানুষকে। পুরান ঢাকার বিরল রেসাস প্রজাতির বানরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। কারণ বিষয়টি শুধু বানর নয়, বানর পরিবেশ, ইতিহাস সব মিলিয়ে ঢাকার আদি প্রাণীর আসন অলংকৃত করে আছে। তাই বানর রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে বানর রক্ষার দায়িত্বটা সিটি করপোরেশন নিলে খুব ভালো কাজ হবে। আমাদের প্রত্যাশা এটাই।

n লেখক :কবি ও সাংবাদিক