জামিলুর রেজা চৌধুরী
আমি তো আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। আমরা যখন ছাত্র, তখন কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলো। আমি ১৯৬৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাই এবং উচ্চশিক্ষা গবেষণার জন্য প্রায় পাঁচ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। বাকি সময়, মানে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি। দীর্ঘ ৩৮ বছর শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়াও অনেক প্রশাসনিক দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছে। তার মধ্যে বিভাগীয় প্রধান, ডিন এবং প্রায় ১০ বছর কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক পদে কর্মরত ছিলাম। তাছাড়া বহু বছর সিন্ডিকেট একাডেমিক কাউন্সিল, ডিসিবি নীতি কমিটি এবং অন্যান্য কমিটির সদস্য ছিলাম। কিন্তু ৬ অক্টোবর রাতে দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে আবাসিক হলে যেভাবে নির্যাতন করে কয়েকজন ছাত্র হত্যা করল, তা আমার কাছে অকল্পনীয় মনে হয়েছে। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ২০০২ সালে একটি দলের দুই গ্রুপ সন্ত্রাসীর গোলাগুলিতে এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। তাছাড়া বুয়েটে এমনি ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হয়েছে, কিন্তু যারা এ ধরনের সংঘর্ষে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বুয়েটের আইন অনুযায়ী তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
আবরার ফাহাদ হত্যার পরে এখন বেরিয়ে আসছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে ছাত্রদের নির্যাতন কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার পরও বেশির ভাগ ঘটনায় কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন হলো, প্রশাসন, বিশেষ করে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ও হলের প্রভোস্টরা এতদিন কী করেছেন? তারা কি জানতেন না বা দেখেননি হলের ভেতরে যে ভীতিকর পরিস্থিতি ছাত্রনেতারা সৃষ্টি করে রেখেছিল? এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন? তারা ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তারা যদি সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে আবরার ফাহাদের এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না। একথা শুধু আমি নই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীয় বলেছেন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কিছু জানা যায়, যা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়। প্রায় প্রতিটি হলেই মূল রাজনৈতিক দলের সমর্থক দলসমূহের ছাত্রসংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। আর কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করার প্রবণতা এদের দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু সব ছাত্রছাত্রীকে আবাসিক হলে থাকার জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাই সিট বণ্টনে ছাত্রসংগঠনগুলো বিরাট ভূমিকা রাখে। যে দায়িত্ব হলের প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্টদের পালন করার কথা, তা অনেকটাই এখন ছাত্রনেতারা নিয়ন্ত্রণ করে। আমার শিক্ষকতা জীবনের সময়ে আমি দেখেছি, হলে প্রভোস্টদের নির্দিষ্ট অফিস ছিল এবং তারা প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিসে যেতেন, ছাত্ররা তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য তার সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং তিনি ও তার সহকারীদের নিয়ে এর সমাধান করে দিতেন। সে সময় ছাত্ররা প্রভোস্টের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করতে সাহস পেত না। তারা জানত যে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি তো অনেকগুলো তদন্ত কমিটির সদস্য বা চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছি এবং অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছি। সেই সুপারিশ অনুযায়ী উপাচার্যের নেতৃত্বে যে ডিসিপ্লিন কমিটি আছে, তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত। অথচ এখন দিনে দিনে কী দূরাবস্থাই না সৃষ্টি হয়েছে!
যে কোনো দল থেকে কমিটির সামনে হাজির হয়েছে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে একটি করে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ছিল এবং ইকসু নামে পরিচিত একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ছিল। বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট সুষ্ঠু পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতো এবং একেক সময়ে একেক দল সমর্থিত অথবা নির্দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হতো। কিন্তু কোনো সময় মারামারি হতো বলে আমার মনে পড়ে না। ভিন্ন মত থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। একটি উদাহরণ দিলে কিছুটা পরিষ্কার হবে।
১৯৬৯ সালে আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সংসদে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং হলের রুমমেট তারাই সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ছিলেন। তারা যখন হোস্টেলের বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে ভোটের জন্য ক্যানভাস করতেন, দুজনেই একসঙ্গে যেতেন। গিয়ে পরিচয় দিয়ে তারা নির্বাচিত হলে কী কী পদক্ষেপ নেবেন তা বলতেন। পরের বছর আবার দুজন সহসভাপতি পদে নির্বাচন করছিলেন এবং একই পদ্ধতিতে তারা প্রচারণা চালাতেন। দুজনই পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন রাজনীতিতে যোগ দেন এবং মন্ত্রী হয়েছিলেন, অন্যজন সরকারি চাকরিতে সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
বর্তমানে বুয়েট ট্রাস্টি বোর্ডে কয়েকজন আছেন, যারা বিভিন্ন দল থেকে ছাত্র হিসেবে আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে কেন্দ্রীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন দল থেকে হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক সব সময়ই সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে, বিভিন্ন দলের বা ভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থী হলেই তার ওপর নির্যাতন করা বা হল থেকে বের করে দেওয়া, এই অবস্থা ছিল না। আমার ধারণা, এই শক্তির উত্স রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে থেকে তারা অর্জন করে।
৬ অক্টোবরের এই হত্যাকাণ্ডের পরে সরকার খুব বিপদে পড়ে। যারা জড়িত ছিল তারা সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়। তাদের গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত আমরা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংগঠনের অপরাধ বিগত দিনে রাক-ঢাক করতে দেখেছি। কিন্তু এই ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বর্বরতা বুয়েট ক্যাম্পাসে না ঘটে। এ ছাড়া বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও বুয়েট অ্যালামনাই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। বুয়েটের উপচার্য ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সবই মেনে নিয়েছেন এবং যেগুলো ক্ষমতার বাইরে, সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। আমি আশা করি, এগুলো বাস্তবায়িত হলে ক্যাম্পাসের, বিশেষ করে আবাসিক হলের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং বুয়েটের শিক্ষক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে।
n লেখক : জাতীয় অধ্যাপক