শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হাতপাখার গ্রাম

আপডেট : ১৮ মে ২০১৯, ২২:১৩

নিকলী উপজেলার সূত্রধর পাড়ার ৫০০ নারীর জীবিকা চলে বাহারি তালপাতার পাখা বানিয়ে

দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা

‘তালের পাখা/ প্রাণের সখা/ গরমকালে দিও দেখা।’ পাখার উপযোগিতা নিয়ে এখনও গ্রাম-গঞ্জে প্রচলিত রয়েছে ছড়াটি। বৈশাখ গিয়ে এখন জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় গরমের দাপট বেশি। প্রখর রোদে ভ্যাপসা গরমে যখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসাবে দেখা দেয় লোডশেডিং, তখন মানুষের প্রাণ হয়ে যায় ওষ্ঠাগত। এমন সময় শরীর জুড়াতে অনেকেরই ভরসা হয়ে উঠে হাতপাখা।

হাতপাখার ভুবনে বেশি জনপ্রিয় তালপাতা দিয়ে তৈরি পাখা। এই তালপাতার পাখা যেমন অনেককে গরমে আরাম দেয়, তেমনি পাখা বানিয়ে বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে ঘোরে অনেকের সংসারের চাকা। এমনই একটি গ্রাম কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সূত্রধরপাড়া। যেখানে প্রায় ৫০০ নারীর জীবিকা চলে তালপাতার পাখা বানিয়ে বিক্রি করে। তালপাতার নানা রকম বাহারি পাখা তৈরির জন্য সূত্রধরপাড়া ইতোমধ্যে ‘পাখা গ্রাম’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।

বাড়ি বাড়ি এক দৃশ্য: নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম সূত্রধরপাড়া। গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবারের সবাই জড়িয়ে আছে তালপাখা তৈরির সঙ্গে। কেউ পাখার কারিগর, কেউ বা ব্যবসায়ী। চৈত্র মাস আসার আগে থেকেই এই গ্রামের দৃশ্যপট বদলে যায়। সব বাড়িতে দেখা যায় এক দৃশ্য। ঘর, উঠান, বাড়ির সামনে বসে নানা বয়সী নারী ও মেয়েরা ব্যস্ত থাকে তালপাতা দিয়ে পাখা বানানো নিয়ে। কার্তিকের শুরু পর্যন্ত চলে এই ব্যস্ততা।

সম্প্রতি সূত্রধরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, এক বাড়ির উঠানে বিভিন্ন বয়সী ১০-১৫ জন নারী ব্যস্ত তালপাতার পাখা তৈরিতে। কেউ পাখা বানাচ্ছে, কেউ তালপাতা পানিতে ভেজাচ্ছে, কেউ পাখার জন্য বাঁশের শলা কেটে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। কথা হয় অর্চনা সূত্রধরের (৩৫) সঙ্গে। এটি তার শ্বশুরবাড়ি। তিনি জানান, তার শাশুড়ি, ননদ, ভাশুরের মেয়েও পাখা বানান। গ্রামের কয়েকজন নারীও তাদের সঙ্গে কাজ করেন। অর্চনা বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করিনি। কিন্তু পাখা তৈরি করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছি। কিছু টাকা সঞ্চয়ও করছি দুঃসময়ের জন্য।’

প্রায় সব বাড়িতেই দেখা গেল পাখা বানানোর এমন ব্যস্ততা। গৃহবধূরা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে হাত লাগান পাখা তৈরিতে। কাউকে কাউকে দেখা গেল, সন্তান কোলে নিয়েই পাখা বানাচ্ছেন। ছোট ছেলেমেয়েরাও সাহায্য করে বড়দের। আর পুরুষেরা এনে দেন তালপাতা এবং পাখা তৈরির নানা উপকরণ। ফলে পুরো গ্রামে পাখা তৈরি অনেকটা শিল্পের রূপ পেয়েছে। গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাখা তৈরি করেই গ্রামের অনেকে সংসার চালান। অনেকে সংসার সাজান। কিছু আছেন মূল কারিগর। কিছু আছেন ব্যবসায়ী, তারা কারিগর দিয়ে পাখা বানিয়ে বিক্রি করেন। যাদের মূলধন নেই, তারা কারিগর বা কারিগরের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাদের সবাই নারী এবং পাখা বানানো তাদের জীবিকা।

কারিগরেরা জানান, একটি তালপাতা দিয়ে ১০টি পাখা হয়। একটি পাখা তৈরির জন্য তারা মজুরি পান ১৫ টাকা। একজন কারিগর দিনে পাচ-ছয়টি পাখা তৈরি করতে পারেন। মজুরি ও উপাদান কেনা বাবদ একটি পাখা তৈরিতে প্রায় ২৫ টাকা খরচ পড়ে। এক একটি পাখা পাইকারিভাবে বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকায়। গ্রামের অনিতা সূত্রধর বলেন, পাখা বানানো শুরুর আগে সংসারে অভাব লেগেই থাকত। পাখা তৈরি করে এখন আমি স্বাবলম্বী।

যেভাবে শুরু: গ্রামটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৬০ বছর ধরে এই গ্রামের নারীরা তালপাখা তৈরি ও বিক্রি করছেন। তবে ঠিক কবে থেকে বা কার মাধ্যমে গ্রামটিতে এই পেশার গোড়াপত্তন, নির্দিষ্ট করে তা কেউ বলতে পারেননি। অবশ্য শুভারানী (৮৫) বলেন, অনেক আগে মিরদা সুন্দরী নামের এক গৃহবধূ এই পাখা তৈরির কাজ তার বাবার বাড়ি থেকে শিখে আসেন। তার কাছ থেকে শেখেন গ্রামের অন্য গৃহবধূরা। একপর্যায়ে তা গ্রামের ঘরে ঘরে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ৩০ বছর আগে মিরদা সুন্দরী মারা গেছেন।

পাখা তৈরি হয় যেভাবে: তালপাখা তৈরিতে ব্যবহার হয় তালপাতা, বাঁশ, বেত, সুঁই-সুতা ও রং। প্রথমে শুকনো তালপাতা চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। তালপাতা পানি থেকে তুলে বাঁশের কঞ্চির কলম লাগিয়ে রোদে শুকানো হয়। এরপর ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে তালপাতার চারদিক গোলাকার করা হয়। পরে পাখায় রং মাখানো হয়। সবশেষে পাখায় বেত আর শলা দিয়ে সুঁই-সুতার কাজ করা হয়। পাখায় নান্দনিক সৌন্দর্য ফোটাতে অনেক কারিগর রঙিন সুতা দিয়ে চোখজুড়ানো নকশাও করেন। সূত্রধরপাড়ার তালপাখা পাইকারি হিসেবে কিনে নিয়ে যান আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার পাইকারেরা। তাদের একজন বাজিতপুরের সাহেদ মিয়া। তিনি বলেন, প্রতিটি পাখা আমরা ৪০ টাকা করে কিনি।

প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা: দামপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের বলেন, সূত্রধরপাড়ার পাখা তৈরির কাজ এখন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। গ্রামটি পাখাপাড়া হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এ কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এখনই প্রয়োজন।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুছাম্মত্ শাহীনা আক্তার বলেন, তালপাতা দিয়ে পাখা বানাচ্ছেন সূত্রধরপাড়ার নারীরা। প্রাণচঞ্চল ওই গ্রামের আশপাশের গ্রামগুলোতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি কম। তারপরও বলব, নারীরা কাজ করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করছেন। শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমার পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।