শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আমাদের তো স্কুল ব্যাগই ছিল না

আপডেট : ১২ জুন ২০২১, ১৯:২২

ঝর্না রহমান, কথাসাহিত্যিক

গতকালের পর

আমার মনে হত যে সব স্যার ম্যাডাম কড়া মেজাজের, কেবল বকাঝকা করেন, তাঁদের আমরা শুধু ভয়ই পেতাম, সে কারণে তাঁরা কী পড়াতেন তা আমাদের মাথায় ঢুকতো না। আবার বুঝতে না পারলেও ভয়ে জিজ্ঞেস করতাম না। জুলফিকার স্যার, লতিফ স্যার এঁরা আমাদের সাথে আপনজনের মত হেসে কথা বলতেন। আমরা তাঁদের ভয় পেতাম না বলে কিছু না বুঝলে সরাসরি প্রশ্ন করতাম। ভয়ভীতিহীন সহজ সম্পর্কের কারণে আমরা স্যারদের সাথে কখনো কখনো মজার কথাও বলতাম। তাঁরাও বলতেন। এভাবে তাঁরা আমাদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আমরা পারতপক্ষে এই স্যারদের ক্লাস মিস করতাম না।

স্কুলের পাঠতালিকায় সব বিষয়ই আমার পড়তে ভালো লাগতো। সবচেয়ে ভালো লাগতো বাংলা। তবে ভূগোল খুব কঠিন লাগতো। বিশেষ করে সমুদ্র স্রোতের বিবরণ। এসএসসি পরীক্ষায় সমুদ্র স্রোত আর কন্টুর মানচিত্র থেকে প্রশ্ন এসেছিল। দুটোই এঁকে দেখাতে হবে। আমি ছবি আঁঁকতে খুব ভালোবাসতাম। আঁঁকতে পারতামও সুন্দর করে। কিন্তু ভূগোলের চিত্র যে পেনসিল স্কেচ বা ল্যান্ডস্কেপের মত করে আঁঁকতে হয় না, এটি আমার শিক্ষক শেখাননি। আমি দারুণ শেড দিয়ে ত্রিমাত্রিকতা যুক্ত করে সমুদ্রস্রোতের ছবি আঁঁকলাম। আর কন্টুর মানচিত্র যে কী এঁকেছিলাম, ভাবলে হাসি পায়। ভাগ্যিস ভূগোলে ফেল করিনি। কম নম্বর পেয়েছিলাম। তবে অন্য বিষয়ে আবার এত ভালো করেছিলাম যে ১৯৭৪ সনে আমাদের স্কুল থেকে আমি মানবিক বিভাগে তিনটি লেটারসহ প্রথম বিভাগে পাস করেছিলাম। সনাতন পদ্ধতির পরীক্ষায় ঐ স্কুলে এটিই ছিল রেকর্ড রেজাল্ট। যদিও আমি কখনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়িনি, বাসায়ও খুব বেশি সময় পেতাম না পড়ার, কারণ আমি ছিলাম পরিবারের বড় মেয়ে। আমার ছোট ছোট আরও কয়েকজন ভাইবোন। আম্মাকে কাজে সাহায্য করা ছাড়াও ভাইবোনদের লেখাপড়ার তদারক করা, সবার জামাকাপড় সেলাই করা এসব কাজ আমি করতাম। আর আমার ছিল প্রচণ্ড বই পড়ার নেশা। প্রতিদিন কমপক্ষে একটা বই শেষ করতাম আমি। কখনো কখনো তিনচারটা বইও একদিনে পড়ে শেষ করেছি। ক্লাসের বইয়ের নিচে গল্পের বই রেখে পড়তাম। এমন কি এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার আগের রাতে আমি নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘বাবলু’ আর ‘মৃত নক্ষত্র’ দুটি বই শেষ করেছি। গল্পের বই হাতে থাকলে সেটা শেষ না করে আমি পড়ার বইয়ে মনই দিতে পারতাম না। যা পেতাম তা-ই পড়তাম। নীহাররঞ্জন, নিমাই যেমন পড়তাম তেমনি বঙ্কিমচন্দ্র শরত্চন্দ্র বিভূতিভূষণ আশাপূর্ণা দেবী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এঁদেরও অনেক বই আর গল্প পড়েছি। এমন কি ক্লাস সেভেনে থাকতে আমি এমিল জোলার ‘নানা’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ আর মদনকুমার ও মধুমালার পুঁথি পড়েছি! তবে সবই পড়তাম লুকিয়ে। আব্বার আম্মার চোখে পড়লে তো রেহাই নেই! পেট ভরে বকা খেতে হবে!

আব্বা আমাদের অঙ্ক করাতেন। বিশেষ করে অ্যালজেব্রা আর জ্যামিতির সূত্র খুব ভালো বোঝাতে পারতেন আব্বা। পাটিগণিতও আব্বাই করাতেন। এসএসসিতে অঙ্কে লেটার পেয়েছিলাম আব্বার জন্যই। স্কুল জীবনে আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল একটাই। সংগীত শিল্পী হওয়া। আমার মনে হত, আমিও লতা মুঙ্গেশকরের মত বড় শিল্পী হতে পারবো। কারণ আমি খুব ভালো গাইতে পারতাম।

আমাদের স্কুল ছিল অন্যরকম। সেখানে নিয়ম ছিল শৃঙ্খলা ছিল কিন্তু কোনো নিয়মের বাড়াবাড়ি ছিল না। ক্লাসে পড়ানো হত ঠিকঠাক।   বছরে দুটি পরীক্ষা হতো। ষান্মাসিক আর বার্ষিক। কোচিং বলতে আমরা বুঝতাম এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে স্কুলেই স্যারদের করানো কিছু অতিরিক্ত ক্লাস। কোচিং বাণিজ্য বলতে কী বোঝায় আমরা জানতাম না। বিজ্ঞাপন, লিফলেট, ফোল্ডার এসব কিছুই ছিল না। আমাদের তো স্কুল ব্যাগই ছিল না।