বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যুদ্ধে যেতে হবে ভেজালের বিরুদ্ধে

আপডেট : ১৭ মে ২০১৯, ২১:৪৮

 

ছোটবেলায় দেখেছি বড় কোলা, ড্রাম, ভুসি বা তুলার মধ্যে কলা, বেল, আম, আতা, সবেদা ইত্যাদি ফল রেখে পাকানো হতো। কলার ছড়া গর্তের ভেতর খড়ের ওপর একত্র করে চারপাশ এবং ওপরে খড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। কয়েকদিন পর পাওয়া যেত সুস্বাদু ফল। এ ধরনের পদ্ধতিতে ইথিলিনের (বিশেষ ধরনের হরমোন) যে কত বড় ভূমিকা রয়েছে তা তাদের জানা না থাকলেও পূর্ববর্তী বংশধরদের কাছ থেকে তারা ঠিক পদ্ধতিটি শিখেছিল। যুগের সঙ্গে পালটেছে পদ্ধতিও। ছোট আকারের এক বোতল ফরমালিন ওষুধ হিসেবে এক ড্রাম পানিতে মিশিয়ে তাতে চুবিয়ে রেখে বাজারজাত করা হচ্ছে পটল, করলাসহ অন্যান্য সবজি। কাজটা একবার করতে পারলেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে পণ্য আর পচবে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে না জেনে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশালেও বিভিন্ন আড়তের ঘটনা একেবারেই উলটো। সেখানে এগুলো মেশানো হয় জেনে-বুঝে। অতি মুনাফা লাভের আশায় অসাধু আড়তদাররা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মৌসুমি ফল বা কাঁচা সবজি যেমন টমেটো সস্তা দামে কৃষক বা বাজার থেকে কিনে কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে তাতে পচনরোধক ফরমালিন ব্যবহার করে গুদামজাত করে থাকে। পরে চড়াদামে বাজারে বিক্রি করে। তাদের ভাষায়—ফরমালিন একটি প্রিজারভেটিভ। অথচ ফল পাকার জন্য গাছের নিজস্ব এক প্রকার হরমোন (ইথিলিন) প্রধান ভূমিকা রাখে। অপরিপক্ব অবস্থায় গাছ থেকে ফল পেড়ে কৃত্রিমভাবে পাকালে তার রং, স্বাদ কোনোটাই আশানুরূপ হয় না। বাজারে কলাসহ বিভিন্ন ফলের ভেতরে একাংশ নরম তো অন্য অংশ শক্ত এবং স্বাদও বিশ্রী। ফলের আড়তে কার্বাইডের পুটলি রেখে বা কার্বাইড মিশ্রিত দ্রবণে চুবিয়ে বা অনেক ক্ষেত্রে স্প্রে করে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো হয়। ইথিলিনের ব্যবহারে অনুমতি থাকলেও, কোনো অবস্থায় কার্বাইড বা ফরমালিন ব্যবহারের অনুমতি নেই।

ভেজাল দেওয়ার প্রক্রিয়ায় খাদ্যশস্যে বহির্জাত পদার্থ সরাসরি যোগ করা হয়। যেমন ওজন বৃদ্ধির জন্য বালি বা কাঁকর, ভালো শস্যের সঙ্গে কীটপতঙ্গ আক্রান্ত বা বিনষ্ট শস্য মেশানো ইত্যাদি। কেউ কেউ ধানভানার সময় খুদ ও কুঁড়া যোগ করে ওজন বাড়ায়। আজকাল দানাশস্য-এর সঙ্গে শস্যদানার আকারের প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরা আর ডালের সঙ্গে রঙিন টুকরা মেশানো হয়। অনেক সময় মজুদ খাদ্যশস্যের ওজন বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ তাতে পানি ছিটায়। ইদানীং কৃত্রিম রং ও গন্ধদ্রব্য আবিষ্কারের ফলে চর্বি দিয়ে নকল ঘি বানিয়ে ভোক্তাদের সহজেই ঠকানো যায়। সয়াবিন তেল বা পাম তেলের সঙ্গে এলাইলআই-সোথিওসায়ানেট মেশালে তাতে সরিষার তেলের মতো ঝাঁজ হয় এবং সহজেই সরিষার তেল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। দুধের মাখন তুলে নিয়ে অথবা দুধে পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বাজারজাত করা হয়। গুঁড়াদুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো খুবই সহজ। ব্যবহূত চা পাতা, কাঠের গুঁড়া ও শুকনা পাতার গুঁড়া দিয়ে চায়ে ভেজাল দেওয়া হয়। মসলার মধ্যে লঙ্কা বা হলুদ গুঁড়াতে সীসাজাতীয় রঞ্জক পদার্থ মিশিয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়ানো হয়। মিষ্টি তৈরিতে ছানার পরিবর্তে বেশি বেশি চালের গুঁড়া, টিস্যুর গুঁড়া বা ময়দা  মেশানো হচ্ছে। কোমল পানীয় তৈরিতে তরল গ্লুকোজ বা চিনির সিরাপের পরিবর্তে প্রায়শ ব্যবহূত কার্বোক্সি মিথাইল সেলুলোজ মেশানো হয়। বিভিন্ন ফলের রসের নামে কৃত্রিম ও নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করে নকল রস  তৈরি হয়ে থাকে। মিনারেল ওয়াটার নামে বাজারে যে পানির ব্যবসা চলছে তাতে গুণ ও মানের নিশ্চয়তা অতি সামান্য বা অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। এভাবে খাদ্যপণ্যে ভেজাল অনেক বেশি মারাত্মক। কেননা খাদ্যে ভেজালের মাধ্যমে কোনো একজন ব্যক্তি নয় বরং গোটা জাতি তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। মৌসুমি ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পণ্য, জিলাপি, ফার্স্ট ফুড, পশুখাদ্য, ঔষধ সকল দ্রব্যেই রয়েছে ভেজাল।

সম্প্রতি ভেজালবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ টিম ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে এবং তাদেরকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং তা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে হতে হবে সোচ্চার। যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে ভেজালের বিরুদ্ধে।

ঢাকা