বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কর্মসংস্থান সংকট ও ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রা

আপডেট : ০৭ জুন ২০১৯, ২২:০৭

 

গত ১২ মে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ পায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনা। অবৈধ উপায়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ যাত্রাপথে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হলো ৩৯ জন বাংলাদেশি। সাগরপথে লিবিয়া হয়েই তালি যাত্রাপথে যাদের সলিল সমাধি হলো, তারা অধিকাংশই তরুণ। এদেশের যুবসমাজ। ভাগ্য বদলের প্রত্যাশায় তরুণরা ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশের পথে যাত্রা করছে দলে দলে। তাদের এ যাত্রা ভয়ংকর এবং অনিশ্চিত। দেশে কর্মসংস্থান সংকট এবং পছন্দমাফিক কাজ খুঁজে না পেয়ে তারা সহজেই পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছে।

ব্যক্তির অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে একান্ত ব্যক্তিক মুনাফার স্বার্থে কাউকে অবৈধপথে পরিচালিত করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। গত দু’দশক থেকে দেশে মানবপাচারের নবরূপ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশ হয় অবৈধপথে সমুদ্রযাত্রার খবর। দালালচক্র বেকার তরুণদের টার্গেট করছে। তাদের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে অধিক বেতনের চাকরির। ভয়ংকর সাগরপথে এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গমনে। এভাবে তরুণদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অনিশ্চিত জীবনের পথে। যেখানে আছে ব্যক্তিক জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, কর্মের অনিশ্চয়তা, জেল-জুলুম ও নিপীড়নের ভয়।

আমার কর্মজীবনের দীর্ঘ দশ বছর কেটেছে সীমান্তবর্তী বান্দরবান জেলায়। দালালচক্রের কবলে পড়ে সমুদ্রযাত্রার বিষয়টি আমি প্রথম দেখি ২০০৮ সালে। তখন আমি দক্ষিণ-পূর্ব বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় কর্মরত। মনে পড়ছে সুরত আলম নামে এক ব্যক্তির কথা। যিনি উপজেলা পরিষদের একটি দপ্তরে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে ছিল, যে সমাজসেবা দপ্তর থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষাউপবৃত্তি পেত। তার বিপরীতে প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনে ক্ষুদ্র ঋণও মঞ্জুর করা হয়। সুরত আলম গৃহী ঋণ নিয়ে একটি গরু কিনতেন এবং বছর শেষে গরু বিক্রি করে ঋণের সমুদয় অর্থ পরিশোধ করতেন। এতে তিনি বেশ লাভবান হতেন। কিন্তু শেষবার ঋণ গ্রহণ করে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারলেন না। এজন্য তাঁকে অফিসে তলব করা হলো। তিনি উপস্থিত হয়ে ইতস্তবোধ করতে করতে জানালেন, গৃহীত ঋণের সমুদয় টাকা স্থানীয় এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় সাগরপথে এক মালয়েশিয়াগামীকে অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় ঋণ হিসেবে দিয়েছেন। ঐ মালয়েশিয়াগামী বর্তমানে কারাবন্দি।

পাচারকারী দলের একটি সিন্ডিকেট থাকে। স্থানীয় দালালচক্র ৬০-৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে সারা দেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে। একটি ট্রলারে নেওয়া হয় ১১০ থেকে ১৪০ জনকে। প্রতি যাত্রায় ট্রলারের জন্য ২ হাজার লিটার তেল সংগ্রহ করা হয়। যাত্রাকালে নেওয়া হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল, ডাল, আলু, লবণ, চিড়া ও শুঁটকি। মানবপাচারের সবচেয়ে বড় রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্র তীরবর্তী কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট এবং চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী ও মাঝিরঘাট হয়ে মানুষ পাচার হয়ে দেশান্তরী হচ্ছে।

গত মে মাসে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ৩৯ জন বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যুতে দেশ-বিদেশ আলোড়িত হয়। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ১১৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্যমতে, এ বছর প্রথম চার মাসে সাগরপথে লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ১৬৪ জন লোক মারা যায়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে মেক্সিকোর দুর্গমপথে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি আটক হয়, যাদের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে আটক হয় ১৯২ বাংলাদেশি, যাদের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের গণকবরের কথাও ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

মানবপাচার দেশের একটি আর্থ-সামাজিক সংকট। বেকারত্ব বা কর্মসংস্থান সংকট এ সমস্যাকে বৃদ্ধি করছে বহুগুণে। তরুণদের জন্য চাহিদামাফিক কর্মসংস্থান সুযোগ সৃজন করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ীমহল। যাঁদের প্রতি তরুণসমাজের দাবি আছে। তারা চায় দেশের পুঁজিপতিগণ ব্যাপকহারে উত্পাদনমুখী ও রপ্তানীমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করুক। আমদানিনির্ভরতায় দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। কোটিপতি ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ কর্মসংস্থান সৃজনমূলক দেশীয় বিনিয়োগে এগিয়ে এলে মানবপাচারের শিকার হয়ে তরুণরা দেশত্যাগী হবে না, বরং দেশের কল্যাণেই বিনিয়োগ করবে তাদের মেধা, শ্রম ও কর্মশক্তি।

চট্টগ্রাম