শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিন

আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৯, ২১:৩৩

সাধন সরকার

 

বর্ষা চলছে। পুরো বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। বর্ষা আসে আর পাহাড়ধস নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিবছর পাহাড়ধসে জানমালের ক্ষতি হয়ে থাকে। এর প্রধান কারণ, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো করে থাকতে না দেওয়া। পাহাড় কেটে পাহাড়ের পাদদেশে গৃহহীন মানুষের বসতি স্থাপন পাহাড়ের স্থায়ী ক্ষতি করে চলেছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড় কেটে একদিকে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে ত্বরান্বিত করছে পাহাড়ধস।

দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১১-১২ ভাগ পাহাড়ি এলাকা। বলা যায়, পাহাড়সহ আমাদের দেশের সামগ্রিক এলাকা পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। পাললিক শিলা স্তরে স্তরে গঠিত হওয়ায় বিভিন্ন সময় এর ভূভাগের ক্ষয় ও অপসারণ হয়ে থাকে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত বেলেপাথর, কর্দমপাথর ও বালি সমৃদ্ধ। বর্ষা মৌসুমে একটানা বৃষ্টিতে বেলেপাথর ও বালি সমৃদ্ধ পাহাড়ের মাটির বন্ধন আলগা ও দুর্বল হয়ে পাহাড়ধসের অবস্থা তৈরি হয়। পাহাড়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিত বনায়ন করা হয়েছে। বন উজাড় করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণেও ব্যাপকভাবে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে। পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলেই বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘প্রাচ্যের রানি’ বলা হয়। ‘বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার’ খ্যাত এ শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে এ শহর ও অঞ্চলের আত্মিক বন্ধন। পাহাড় ধ্বংস করা হলে এ শহরের ভৌগোলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে। সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্রের লালসা পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। পাহাড়কাটা থেমে নেই! বেলেমাটির পাহাড় একটু কাটা হলেই বাকি অংশও ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ের পাহাড়ধসের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৭ সালে নিহত হয় প্রায় ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালের ২৮ জন, ২০১৩ সালে ২ জন, ২০১৭ সালে প্রায় ১৫০ জন। সামনের বছরগুলোতে পাহাড়ধস আবারও যে মৃত্যুর কারণ হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই! সহজকথায় পাহাড়কাটা বন্ধ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সব ধরনের বসতি উচ্ছেদ করতে হবে।

২০০৭ সালে প্রাণহানির পর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি পাহাড়ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড়ধস বন্ধে কিছু সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে আজ পাহাড়ধস নিয়ে এত চিন্তিত হতে হতো না। পাহাড়ে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি, বন উজাড়, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ এবং পাহাড় কাটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাহাড়ধস বন্ধে পুরো পাহাড়ের চারপাশে পাথর ও সিমেন্টের ব্লক তৈরি করা হয়। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের জন্য রাখা হয় পৃথক ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও এখন এ প্রযুক্তিতে পাহাড় রক্ষার কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। পাহাড়ধস বন্ধে এ ব্যবস্থাপনায় এখানে বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করে দেখা যেতে পারে। পাহাড়গুলো আমাদের সম্পদ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না! ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের ক্ষতি করে চললে পাহাড়ও একসময় তার প্রতিশোধ  নেবে। পাহাড়কে নিজেদের স্বার্থে কোনো গোষ্ঠী বা চক্র যেন ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। পাহাড় সকলের জন্য নিরাপদ হোক। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষা ও পর্যটনের বিকাশে পাহাড় রক্ষা করতেই হবে।  

ঢাকা