শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উচ্চশিক্ষার দীনতা:প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৪৬

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

 

আমার মতে, শিক্ষা হলো একটি তালগাছ। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, তালগাছ যেমন লিচুগাছের মতো যত্ন করে লাগানোর দরকার নেই; লাগালেও চলে, না লাগালেও চলে। সে আপনি জন্ম নেয়। যত্ন-আত্তিরের তেমন ধার ধারে না। আপন মনে বড় হতে থাকে। নীরবে নিভৃতে মানুষের উপকার করে যেতে থাকে। ছায়া দেয়, ফল দেয়, কাঠ দিয়ে ঘরবাড়িও তৈরি করা যায়। এমনকি বজ্রনিরোধক হিসাবেও কাজ করে থাকে। হাজার মাইল গতিবেগের ঝড়েও ভেঙে যায় না। শিক্ষাও এবং শিক্ষিত মানুষও তেমনি। তারা অন্যায়ের কাছে, অসত্যের কাছে, অসুন্দরের কাছে কখনো মাথা নোয়ায় না।

এখানে শিক্ষা বলতে কেবল আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই আমি বোঝাইনি। ‘শিক্ষা’ শব্দটি আরো কোটি কোটি গুণ বেশি বড় এবং ব্যাপক। এই যেমন গরুর বাচ্চাকে কেউ হাঁটা শেখায় না। শেখাতে হয় না। কুমিরের বাচ্চাকেও সাঁতার শেখাতে হয় না। তেমনি পাখির ছানাকেও ওড়া শেখাতে হয় না। কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে হাঁটা শেখাতে হয়। অক্ষর জ্ঞান লাভ করতে হলে কারো না কারো সাহায্য লাগে। সনদপত্র লাভের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি থাকতে হয়। তবে এসবের বাইরেও মানুষ আরো অনেক শিক্ষায় আপনি শিক্ষিত। যেমন বুদ্ধি, বিবেক, আত্নসংযমের মতো উন্নত গুণাবলি। এদের মতো আরো হাজারো বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষা খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। প্রকৃতি আপন হাতে গড়ে দেয়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেবল ভোঁতা তলোয়ারে শান দেওয়ার কাজ করে থাকে। তাহলে শিক্ষা কী? শিক্ষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিকসহ মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধন করা।

আমি গরুখোঁজা খুঁজেছি, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার কোনো স্বরূপ খুঁজে পাইনি। এর কি আদৌ কোনো কার্যকর নীতিমালা আছে? সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ইউনিয়ন/গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-নগরে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অভাব নাই। শতকরা হিসাবের চুলচেরা পরিসংখ্যানে না গিয়েই নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়াদের বাদ দিলে বাকি সবাই কোনো না কোনোভাবে উচ্চশিক্ষিত। এখানেই আমার প্রশ্ন; কর্মের যথাযথ সংস্থানের ব্যবস্থা না করেই যেভাবে উচ্চশিক্ষার হার বাড়ানো হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবে ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক হারকেও হার মানিয়েছে। এতে ভালোর চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। আমি বলতে চাইছি, একটা দেশের মাথার ওপর যখন অকর্মা, শিক্ষিত বেকার মানুষ চেপে বসবে, তখন এই জাতির কী হবে? যেখানে উচ্চশিক্ষার লাগাম টেনে ধরা একান্তভাবে জরুরি, সেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরো ৮৪টি কলেজে অনার্স খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে! একটি দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি যখন উচ্চশিক্ষার তকমা গলায় ঝুলিয়ে বেকারত্বের মহান (!) অভিশাপ নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবে, তখন তাদের বাস্তব অবস্থা কীরূপ হতে পারে ভাবাও দুষ্কর! নিশ্চিতভাবেই তারা আইন অমান্য করা শুরু করতে বাধ্য হবে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হবে। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। দেশের অর্থনীতির উপর ক্রমাগত চাপ বাড়বে।

সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এখনই উচ্চশিক্ষার লাগাম টেনে ধরা দরকার। প্রকৃত মেধাবী এবং অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া উচিত। এ সংখ্যা হতে পারে বড়জোর ১০ থেকে ১৫%।  উচ্চ মাধ্যমিকের পরে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীদের গভীর এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত মেধা এবং ঝোঁক নির্ণয় করা হোক। সে অনুযায়ী তাদের সারা দেশে বিভিন্ন সেক্টরে এবং বিদেশের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করা উচিত।

শিক্ষার মান নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠছে এবং ভবিষ্যতেও উঠবে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, এবার এশিয়ার ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

ময়মনসিংহ