শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নতুন পথে বাংলাদেশ

আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৫০

শাহনাজ পারভীন

 

‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’—বঙ্গবন্ধু এ বাক্যটি প্রায়ই উচ্চারণ করতেন অসাধু দুশ্চরিত্র দুর্নীতিবাজ কালোবাজারিদের ইঙ্গিত করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেওয়া তাঁর ভাষণে শক্তভাবেই বলেছিলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উত্খাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন— আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান—করাপশন। খাদ্য কিনতে যান— করাপশন। জিনিস কিনতে যান—করাপশন। বিদেশে গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫% শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। বাংলার মাটি  থেকে এদের উত্খাত করতে হবে।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড়ো ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহত্ র্অথনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। গত ২৯ আগস্ট ‘দ্য ্পেক্টেটর ইনডেক্স’-এ প্রকাশিত বিশ্বের ২৬টি শীর্ষ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, বাংলাদেশ জিডিপিতে (মোট দেশজ উত্পাদন) অর্জন করছে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।

আমরা যদি বিগত কয়েক বছর আগে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই—২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল ২০১৭ সালে। তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সতেরো। এ বছর চার ধাপ অবনতি হয়ে ১৩তম অবস্থানে আসে। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে সবগুলো পরীক্ষায় পাশ হলেই কেবল ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব। ভয়াবহ দুর্নীতি, সম্পদের অসম বণ্টন, উন্নত দেশের অভিযাত্রায় এক মহা বাধা। যেখানে আমরা টেকসই উন্নয়নে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন, ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, নৈতিকতার চর্চা বাদ দিয়ে হঠাত্ দ্রুত অর্থবিত্তের মালিক হতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের উন্নয়নকে কতটা টেকসই করবে—সেটা এখনই ভাবার সময়।

বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে অর্থনৈতিক সুশাসনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর সুশাসনের জন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, কিউবা, চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরান দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী গান্নার মিরডাল ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার বই ‘এশিয়ান ড্রামা’য় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দুর্নীতিকে বিরাট বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

দুর্নীতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেয়। এভাবে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, বাজটে ঘাটতি দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি বাড়ে, সামাজিক পরিবেশ কলুষিত হয়। যার প্রভাবে গোটা সমাজব্যবস্থা এক ধরনের মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে। দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট ভোগান্তির বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষকেই। তাই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার পরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এখনই সময় উদ্যোগী হবার।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বলেন, ‘একাত্তরের মতো প্রতিটি ঘরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ’-এর কথা। যার কার্যকারিতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা এজন্য সাধুবাদ জানাই বর্তমান সরকারকে। রূপকল্প ২০২১, রূপকল্প ২০৪১ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসহ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে সোনালি অর্থনীতি গড়ার দিকে।

গাজীপুর