শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইংল্যান্ডের স্বপ্ন ছোঁয়ার বছর

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:২৮

বছরটা তো বটেই, গেল এক দশকেই যদি ক্রিকেট বিশ্বের কোনো আক্ষেপ থাকে তার সবটাই যেন ঘুচে গেল অনবদ্য রোমাঞ্চকর এক বিশ্বকাপ ফাইনাল দিয়ে। লর্ডসের সেদিনের রাতে কি না ছিল! ছিল অনিশ্চয়তার খেলা, আর গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলাটি যেন আবারও ফিরে পেল তার হারানো সুদিন।

 সেদিন ছিল ১৪ জুলাই। প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দুদল। নিউজিল্যান্ড ৫০ ওভারে ২৪১ রান করে। ওয়ানডে ক্রিকেটে আজকাল আর এটা দিয়ে বড়ো কোনো কিছু স্বপ্ন দেখা যায়। তবুও নিউজিল্যান্ড দারুণ লড়াই করে।  প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যায় সেই লড়াই। ম্যাচ গড়ায় অন্তিম মুহূর্তে।

তিন বলে তখন জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের দরকার নয় রান। বোলিংয়ে ট্রেন্ট বোল্ট। ব্যাটিংয়ে বেন স্টোকস। নন স্ট্রাইকে ছিলেন আদিল রশিদ। স্টোকসে যে করেই হোক স্ট্রাইক ধরে রাখতে মরিয়া ছিলেন। কারণ তিনি স্ট্রাইক পালটালেই ট্রফি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কার মুখে পড়তে হতো ইংল্যান্ডকে।

 শেষ ওভারের চতুর্থ বলটায় মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে দুই রান নেওয়ার চেষ্টা করেন স্টোকস। ওপার থেকে বল থ্রো করেন মার্টিন গাপটিল। শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে ড্রাইভ দেন স্টোকস।

বলটি তার ব্যাটে লেগে বাউন্ডারিতে চলে যায়। ব্যাট হাতে দুই আর ওভার-থ্রোতে চার রান মিলে ইংল্যান্ডের স্কোর বোর্ডে ছয় রান যোগ করার নির্দেশ দেন লঙ্কান আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা। শেষ দুই বল থেকে ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য তিন রান দরকার ছিল। ইংল্যান্ড করে দুই রান। ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে। সুপার ওভারে দুদলই ১৫ করে রান করলে বাউন্ডারিতে এগিয়ে থেকে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় ইংল্যান্ড।

ম্যাচ শেষে ঐ ওভার থ্রোর ডেলিভারিতে ছয় রান আসা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। আইসিসির আইনের ১৮.৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী ওভার থ্রোতে যদি বাউন্ডারি আসে, তাহলে দৌড়ে নেওয়া রানের সঙ্গে সেটা যোগ হয়। তবে সেক্ষেত্রে বাউন্ডারির সঙ্গে দৌড়ে নেওয়া রান ততগুলোই যোগ হবে যতগুলো ব্যাটসম্যানরা শেষ করেছে। অর্থাত্, ফিল্ডার বল থ্রো করার মুহূর্তে যদি ব্যাটসম্যানরা একে অপরকে অতিক্রম করে তবেই সেই রান যোগ হবে। টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা গেছে রশিদ ও স্টোকস একে অপরকে অতিক্রম করার আগেই গাপটিল থ্রো করেছিলেন। সেক্ষেত্রে, নিয়ম অনুযায়ী ইংল্যান্ড ছয় না, বরং পাঁচ রান পায়। আর সেই একটা রান কমে গেলেই আর সুপার ওভারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। নিউজিল্যান্ড জিতে যায়।

 রোমাঞ্চ আর বিতর্কে ইতি হয় বিশ্বকাপের। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে যায় ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ড। মিটে যায় দীর্ঘ সময়ের আক্ষেপ। বিশ্বকাপের ফাইনালের ইনিংসটা দিয়েই ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে গিয়েছিল বেন স্টোকসের। বিশ্বকাপ শেষেই অনুষ্ঠিত অ্যাশেজে নিজেকে যেন অমর করে ফেললেন স্টোকস। হেডিংলিতে বেন স্টোকসের অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংসের কথা আরো অনেকদিন মানুষের মুখে মুখে শোনা যাবে। আসলে, অতিমানবীয় বললেও কম বলা হয় রবিবার রাতের এই ইনিংসটাকে। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী বারবার নিজেকে পালটেছেন স্টোকস। প্রথম তিনটি রান করতে খেলেন ৬৭ বল। আবার শেষ ৪৪টি বল থেকে করেন ৭৭ রান। এর সুবাদে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৭ রানে অলআউটের লজ্জায় ডোবা দলটি পায় এক উইকেটের জয়। শেষ অবধি অ্যাশেজের ছাইভস্মটা ইংল্যান্ড জিততে না পারলেও, বেন স্টোকসের ইনিংসটা তাকে অমরত্বই এনে দিয়েছে। বছরটাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আসলে আরো তিনটি ব্যাপারের কথা না বললেই নয়। প্রথম প্রসঙ্গ হলো বিরাট কোহলির আবারও অতিমানব হয়ে ওঠা আর স্টিভেন স্মিথের ফেরা। সময়ের অন্যতম সেরা এই দুই ব্যাটসম্যানের মধ্যে টেস্টের সেরা র্যাংকিংয়ে ওঠা নিয়ে রীতিমতো মিউজিক্যাল চেয়ার হয়েছে। এক বছর পর টেস্টে ফিরেই আবারও সেরা ফর্ম ফিরে পাওয়াটা অবশ্যই স্মিথের সক্ষমতার বড়ো একটা প্রমাণ দেয় আবারও। অন্যদিকে অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান—দুই পরিচয়েই নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে চলেছেন কোহলি।

আর শেষ প্রসঙ্গ হলো ভারতীয় ফাস্ট বোলিং। সংক্ষিপ্ত কিংবা বড়ো পরিসর— যেকোনো ফরম্যাটেই যেন এখন ভারতীয় পেসাররাই সেরা। মোহাম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, জাসপ্রিত বুমরাহ, ভুবনেশ্বর কুমার, উমেশ যাদবরা এই সময়ে এসে এতটাই জ্বলে উঠতে পারছেন যে—প্রায়ই তাদের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই বিখ্যাত পেস বোলিং চতুষ্টয়ের তুলনা চলে।

২০১৯ সালে ভারতীয় পেসাররা সব মিলিয়ে পান ৯৫টি উইকেট। গড় হলো ১৫.১৬। এক পঞ্জিকাবর্ষে কোনো নির্দিষ্ট দলের ফাস্ট বোলারদের মধ্যে এটাই সেরা। কোহলির অধিনায়কত্ব আর পেসারদের পারফরম্যান্সের সুবাদেই তো গেল জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতে ভারত, কারো কারো দৃষ্টিতে এই অর্জনটা বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

২০১৯ সালটা শুরু হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগমনি বার্তা নিয়ে। আর বছরটা শেষ হলো দারুণ এক বিশ্বকাপের স্মৃতি আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পদধ্বনি নিয়ে। কে জানে, আসছে বছরটায় কি নতুন চমক অপেক্ষা করছে!