শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিশিরের স্বপ্নের পাঠাগারের গল্প

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২১, ১১:১১

জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ও এগিয়ে নিতে হলে নিজের অস্তিত্ব তথা দেশ, জাতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়। ইতিহাস সম্পর্কে জানতে বই-পুস্তক ও প্রাচীন নিদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের জানতে বেশিরভাগ সময় নতুন প্রজন্মকে ছুটতে হয় পাঠাগার ও জাদুঘরে; ফলে অতীত নিয়ে আগ্রহের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে এ প্রজন্মের মাঝে।

জানার প্রয়োজনীয়তা ও তার সুযোগে বাধা থাকার এই বিষয়টি নজর এড়ায়নি বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া গ্রামের সাদিকুল বাশার শিশিরের। নিজ গ্রামে তৈরি করেছেন দেশ-বিদেশের জন্য এক অনন্য উদাহরণ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে শিশির প্রতিষ্ঠা করেছেন বর্ণ বিলাস নামের একটি পাঠাগার ও সংগ্রহশালা। স্বমহিমায় উজ্জ্বল এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠাকাল গণনায় মাত্র এক বছরের হলেও এর পিছনে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রাজ্জাক সরকার ও তার পুত্র বর্ণবিলাসের প্রতিষ্ঠাতা, শিশিরের ১৫ বছরের পরিশ্রম। ১৪ বছর ধরে সংগ্রহ করা অসংখ্য বই, দেশি-বিদেশি মুদ্রা, প্রাচীনকালের কিছু তৈজসপত্র ও নমুনা নিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে বর্ণবিলাসকে।

ব্যক্তিগত আগ্রহ, জ্ঞানের তৃষ্ণা ও অনুজ প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই বর্ণবিলাসকে নিয়ে স্বপ্নবুনন করেন শিশির।। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পাঠ্য বইয়ের চেয়ে অন্যান্য বইয়ের প্রতি অন্যরকম একটা ঝোঁক ছিল। বাবা, বোন ওনাদেরকে দেখতাম বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের বই পড়তে। সেই থেকে বই পড়ার প্রতি একটা আলাদা নেশা। তবে পাঠাগার করার ইচ্ছের শুরুটা ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণি থেকে। আমার চাচার ছোট্ট একটা ঘর ছিল; সেখানে বেশকিছু বই, ক্রিকেট, ফুটবল, ক্যারাম, দাবা ইত্যাদি নিয়ে শুরু করেছিলাম।’ পাঠাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণে জড়িত সকলের অবদান পরম কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে বলেন, ‘বড় হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিচয় হয় আখিনুর জামান বকুল ভাইয়ের সঙ্গে; যাকে আমি আমার ছোটবেলার স্বপ্নের কথা জানাই। তার মাধ্যমে পুনরায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে, বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে এবং বাবা-মায়ের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছি এটি।

আমি জানি না নিজে কতটুকু কী করতে পেরেছি বর্ণবিলাসকে এগিয়ে নিতে, তবে যা পেরেছি আমার বাবা-মা ও স্ত্রীর জন্যই।’ শিশির বলেন, ‘ছোটবেলায় এক দোকান থেকে ব্রিটিশ কোয়ার্টার আনা পেয়েছিলাম, আর এক বন্ধুর থেকে ইন্ডিয়ার একটা পয়সা; সেই থেকে মুদ্রা সংগ্রাহক হয়ে ওঠা। ব্যক্তিগতভাবে জমা করলেও বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মুদ্রা ও টাকা পাঠাগারের সংগ্রহশালায় রয়েছে। সংগ্রহশালায় রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক টিকিট থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের প্রায় চার হাজার ডাক টিকিট। পাশাপাশি প্রাচীন আমলের বেশ কিছু তৈজসপত্র ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে পাঠাগারটির সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।’

বর্ণ বিলাস প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা, প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে একবাক্যে শিশির উল্লেখ করছেন বাবার কথা। মুক্তিযোদ্ধা পিতা আব্দুর রাজ্জাক শিখিয়েছেন জীবনকে বইয়ের মাধ্যমে পেতে। বাবার প্রসঙ্গ আসতেই শিশির বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাবা জীবন্ত কিংবদন্তি, বাবা বলেন, ইংগো বংগো কলোংগো— সবই তার চেনা, আগে কথাটার মানে বুঝতাম না, কিন্তু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি।’ বর্ণবিলাসকে নিয়ে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘পাঠাগার ও সংগ্রহশালা আরো বড় করব। শিক্ষা পরিবেশ ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন কিছু হিসেবে খুব ইচ্ছে একটি ডিজিটাল আইটি ল্যাব করার। যেহেতু বর্ণবিলাস পাঠাগার ও সংগ্রহশালা আমার নয় এটি ধুনটের সবার—তাই আমি চাই সবাই এসে বই পড়ুক, ইতিহাস জানুক।’

ইত্তেফাক/জেডএইচডি