মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পারভেজ হাসান

চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেটি এখন অসংখ্য পথশিশুর আশ্রয়

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২১, ১৬:০৪

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন পারভেজ। শৈশব কাটে নানাবাড়িতে। তবে পরিবারের আর্থিক অনটনে পড়াশোনার কথা ভাবা যেন বিলাসিতায় রূপ নেয়। ঢাকায় এনে তাকে পড়াশোনার বদলে মামার চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেয় পরিবার। যে ছেলেটি পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, মাত্র ১২ বছর বয়সে স্বপ্নের বিপরীতে এমন অসহায়ত্বে আত্মহত্যা করার কথা ভাবতে হয় তাকে। চায়ের দোকানের পাশের ব্রিজে উঠে লাফ দেয়ার সময় ছুটে আসে সমবয়সী পথশিশুরা। সবুজ নামে এক পথের শিশু তাকে টেনে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই কি করছিস? মনের কথা বলার মতো যেন একজন সঙ্গী পেলেন তিনি। সেদিন তিনি দুঃখের কথা খুলে বলেন সবুজকে। সবুজ সব শুনে তাদের অনিশ্চিত জীবন সম্পর্কেও বলে পারভেজকে। তারপর তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, তার মত অনেক শিশুই রয়েছে যাদের থাকার, খাওয়ার জায়গাও নেই। ধীরে ধীরে সেসকল পথশিশুদের সঙ্গে গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব।

চায়ের দোকানে কাজের পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। পত্রিকা সংগ্রহ করে বিভিন্ন মানুষের সাফল্যের গল্প পড়তেন। একটি টিভি চ্যানেলে পারভেজদের অসহায়ত্ব নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার হবার পর পড়াশোনার ব্যবস্থা হবারও আশ্বাস মেলে। তবে সেই আশ্বাস দেয়া মানুষটি আর আসেননি। বছরের জানুয়ারি মাসে একবার  পারভেজের জন্মদিনে নিজেদের ফুল ও বেলুন বিক্রির টাকায়  কেক কিনে আনে পথশিশুরা। এই ভালোবাসায় আবেগাপ্লুত হলেন ছোট পারভেজ। কিন্তু পার্কের এক কোনায় বসে কেক কাঁটার দৃশ্য দেখে 'ফকিরের পোলার আবার জন্মদিন' বলে বিদ্রূপ করেন এক কোট-টাই পড়া ভদ্রলোক। এতে কষ্ট পেয়ে শেষপর্যন্ত কেক খাননি পারভেজ।

জিদ চাপে, পড়াশোনা করে বড় হবেন, ব্যবসা করবেন। দোকানের পাশে টেনিস ও গলফ ক্লাবে বলবয় হিসেবে বল টুকিয়ে ৫০ টাকা পেতেন। গ্যালারিতে চা-কফি বানানো থেকে শুরু করে সব করতেন। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিয়ে যেত। টাকা জমিয়ে ১৪ বছর বয়সে দেন চায়ের দোকান। কিছুদিন পর চটপটির দোকান দিয়ে ভালো আয় হতে  লাগলো। শেষে ফাস্টফুডের ব্যবসায় জড়ান। দিনদিন হলো উন্নতি, এলো স্বচ্ছলতা। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি হয়ে উঠলেন সোশ্যাল ফিল্মমেকার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যোগাযোগের সুযোগ হয়। আর আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন মানুষের জন্য কিছু করবেন।

একদিন ঢাকার ধানমন্ডিতে যাবার পথে এক পথশিশুকে ফুটপাতে তার অসুস্থ মায়ের মাথায় পানি ঢালতে দেখে পারভেজ অসুস্থ মা'কে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হন। মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যটা ভিডিওসহ ফেসবুকে তুলে ধরেন ওই পরিবারের দুর্দশার গল্প। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন পুরো পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেয়। এবার পারভেজ ভাবলেন, সংগঠন তৈরি করেই মানুষের সেবায় নামবেন। এমন করে ২০১৮ সালে শুরু হল 'সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের' পথচলা।

এরপর থেকে 'সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন' দেশের যেকোন খারাপ সময়ে মানুষের পাশে থাকে। রমজানে ভাসমান মানুষদের খাবার দিয়েছে। লকডাউনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ একলক্ষ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। বন্যার পানিতে ভাসমান  মানুষদের প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না করে দিতেন। এক টন কাঁচাবাজার, স্যানিটারী ন্যাপকিন, স্যালাইন, মেডিসিন প্রদানের পাশাপাশি টিউবওয়েল ও টয়লেট তৈরি করে দেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় যা প্রয়োজন ছিল সব দেওয়া হতো, বললেন পারভেজ। 'ভাসমান হাসির দোকান' খুলে প্রতি ঈদে জামা-কাপড় দেওয়া হয় পথশিশুদের, যেখানে মাত্র ১ টাকায় নিজের পছন্দ মতো নতুন পোষাক কিনতে পারে তারা। মেডিকেল ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন, মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণসহ নানা কার্যক্রম তো আছেই। এছাড়াও হাতিরঝিলে একশ জনের স্কুল  চালু করা হচ্ছে, যেখানে পড়বে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চারা। নেশায় আসক্ত পথশিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফেরাতে চায়ের ফ্লাস্ক, ফুল বিক্রির বালতি ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে কাজ করতে উৎসাহ দেয়া হয়। তাদের খাবার, চিকিৎসাসহ স্কুলে ফ্রি পড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মূল উদ্দেশ্য, বললেন পারভেজ। তার সংগঠনটি ঢাকা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি দেশের বাইরেও। আর  সংগঠন পরিচালনার অর্থের ৪০ ভাগ আসে পারভেজের ব্যবসা থেকে, বাকিটা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবীদের দেয়া সহায়তা থেকে। তিনবছর আগে বিদেশি সংস্থা বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশন অব টেক্সাস (বায়াট) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন পারভেজ। এখান থেকে পাওয়া বেতনের ৭০ শতাংশ সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করেন। ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্যরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন।

পারভেজ হাসান স্বপ্ন দেখেন, 'সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন' একদিন বড় কমপ্লেক্স স্থাপন করবে। পথশিশু কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবন মানোন্নয়ন, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করবে। সেখানে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, শেল্টার রুম থাকবে। পথশিশুদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সব সেবা দেওয়া হবে। বৃদ্ধাশ্রমে সন্তানহারা ও অসহায় বাবা-মা রা থাকবে। পথশিশু ও অসহায় বাবা-মায়েদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করা হবে। আমৃত্যু মানুষের পাশে থাকাই পারভেজের লক্ষ্য।

ইত্তেফাক/এসটিএম