মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

তীরন্দাজ রোমান সানার গল্প

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২১, ০৪:২২

সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ আর্চারির ফাইনালে বাংলাদেশের জন্য লড়ছেন রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। টিভির পর্দায় হাজারো বাঙালি চেয়ে আছে একটা বিশ্বজয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হওয়া হয়নি সেই মঞ্চে, তবে তারা দু'জন দেশবাসীর কাছে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছেন বহু আগেই। বিশ্বকাপ আর্চারির মঞ্চে ফাইনালে হেরেও ইতিহাস গড়েছেন এই দুই তীরন্দাজ। রৌপ্যপদক জয় করার সাথে সাথে দেশের মানুষের হৃদয়ও জয় করেছেন তারা।

তীর-ধনুকের খেলা কে বলা হয় আর্চারি। যারা খেলেন তারা হচ্ছেন তীরন্দাজ। বিশ্বমঞ্চে নিজের কৃতিত্ব দেখিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম তারকা হয়ে উঠেছেন তীরন্দাজ রোমান সানা। আজ তাঁকে নিয়েই গল্প।

রোমান সানার ছোটবেলা কেটেছে দাদা বাড়ি খুলনা জেলায় কয়রা গ্রামে। বাবা আবদুল গফুর সানা ও মা বিউটি বেগম। গ্রামের পথেঘাটে ছুটে বেড়ানোই ছিলো ছোটবেলার শখ৷ দুরন্তপনা ছিলো নিজের মধ্যে। ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে যাওয়া ছিল দৈনন্দিন রুটিন। ক্রিকেটার নয়তো ফুটবলার—মোটকথায় খেলোয়াড় প্রতি হওয়ার ঝোঁক ছিলো শৈশব থেকে। ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন খুলনার শিশু মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। দু'বছর পর এইচএসসি সম্পন্ন করেন কালিপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০১২ সাল। তবে পড়াশোনার ইতি টানেন এখানেই।

শিক্ষক হাসানের অনুপ্রেরণায় ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রথম আর্চারিতে আসেন রোমান সানা। ২০০৮ সাল থেকে আর্চারিতে পথচলা শুরু হয়। ওইবছর ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতার খোঁজ পান তিনি। শাহাদাত হোসাইন ছিলেন বাংলাদেশ আর্চারি দলের খেলোয়াড়। তিনি খুলনার তীরন্দাজদেরকে সাতদিনের প্রশিক্ষণ দিতে আসেন। ছোটবেলা থেকেই সানার নতুন কিছু করার প্রতি আগ্রহ ছিলো বেশ, সেখান থেকেই আর্চারিতে আগ্রহের জন্ম হয়। ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় খুলনা জেলায় প্রথমও হয়ে গেলেন! এরপর সুযোগ পান ঢাকায় ইয়ুথ আর্চার ট্রেনিং ক্যাম্পে  প্রশিক্ষণ নেওয়ার।

দেশের ১২টি জেলা থেকে ৪০ জন খেলোয়াড় সেখানে নিজেদেরকে ঝালিয়ে নিতে আসেন। সেই ক্যাম্পেও বাজিমাত করেন রোমান সানা, অর্জন করেন প্রথম স্থান। সেখান থেকে সুযোগ পান ২০১০ সালে সাউথ এশিয়া গেমসের জন্য। তখন এসএসসি পরীক্ষার জন্য শেষমেশ যাবার সুযোগ হয়নি। তবে এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে খেলা শুরু করেন তিনি  জাতীয় দলে খেলার সুযোগও আসে কিছুদিনের মধ্যেই।

রোমান সানার অর্জনের ঝুলিতে জাতীয় পুরষ্কারের পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক অর্জন। টানা ৪ বছর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন এই তীরন্দাজ। ২০১২ সালে বাংলাদেশ গেমসে দলগত এবং ব্যক্তিগত- দুই বিভাগেই সিলভার মেডেল অর্জন করেন। ২০১৩ সালে ৮ম বাংলাদেশ গেমসে দলগত এবং ব্যক্তিগত ইভেন্টে দুটো স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০১৪ সালে ৩টি স্বর্ণপদক অর্জন করেন, ব্যক্তিগত, দলগত, মিশ্র দলগত বিভাগে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেও ব্যক্তিগত বিভাগে স্বর্ণপদক অর্জন করার কৃতিত্ব দেখান।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অর্জনের শুরুটা হয় ২০১১ সালের ইয়ুথ আর্চারি চ্যাম্পিয়নশীপে দলগত বিভাগে সিলভার পদক অর্জনের মাধ্যমে। প্রথম স্বর্ণপদক আসে ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে৷ ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে আন্তর্জাতিক আর্চারি টুর্নামেন্টেও স্বর্ণপদক অর্জন করে। ২০১৭ প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশীপে ব্যক্তিগত বিভাগে সিলভার পদক, দলগত এবং মিশ্র দলগত বিভাগে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আসরে রয়েছে রোমান সানার ব্যক্তিগত এবং দলীয় অর্জন৷ ২০১৯ সালে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ানে ব্যক্তিগত বিভাগে সিলভার পদক অর্জন করেন। দলগত বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। এরপর ফিলিপাইনে এশিয়া কাপ স্টেজ থ্রি তে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে চতুর্থ রাউন্ডে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিম ও-জিনকে পরাজিত করে তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এছাড়া নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়া গেমসেও তিনটি স্বর্ণপদক অর্জন করেন রোমান সানা।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ আনসারে সদস্য হিসেবে যোগদান করেন রোমান সানা। সাউথ এশিয়া গেমসে পুরষ্কার অর্জনের পর ২০২০ সালে ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান।

রোমান সানা জানান, একজন আনসার সদস্য হিসেবে খেলাধুলায় স্বাধীনতা অনেক বেশি। খেলোয়াড়দের যেটুকু সুযোগসুবিধা দেয়া হয় সে বিবেচনা এই চাকরিতে এসেছি। তবে তিনি মনে করেন, আর্চারির বড় সংকট হলো ফাইন্যান্সার না থাকা।  বড় বড় ইভেন্টেও স্পন্সর পেতে বেগ পেতে হয়৷ প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা ও সঠিক মূল্যায়ন না পেয়ে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০২৮ সালের অলিম্পিক পর্যন্ত খেলার ইচ্ছে রয়েছে। পরবর্তীতে নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কোচ হতে চান। সানার জীবনের সেরা অর্জন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অলিম্পিকে সরাসরি নির্বাচিত হওয়া। এই প্রেরণা ছড়িয়ে দিতে চান ভবিষ্যতের তীরন্দাজদের মাঝে।

ইত্তেফাক/এসটিএম