দেশে ভয়াবহ মহামারির রূপ নিয়েছে করোনা ভাইরাস। এমন সময় পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লেই মনের মধ্যে বাসা বাঁধে শঙ্কা। একদিকে হাসপাতালে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই, আবার গেলেও নানা সমস্যা—কোভিড রোগী কি না? সেই প্রক্রিয়া শেষ করে মূল চিকিৎসা পেতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। তবে এসব ঝামেলার সমাধান মিলছে একটি অ্যাপে। জরুরি রোগীদের জন্য লাগবে আইসিইউ, কোথায় আইসিইউ খালি আছে, কাছাকাছি কোথায় গেলে মিলবে জরুরি চিকিৎসাসেবা—এসব সমস্যার সমাধান দিচ্ছে স্বাস্থ্যবিষয়ক অ্যাপ ‘হসপিটালিন’।
অ্যাপটির মাধ্যমে সহজেই জানা যাবে আশেপাশে কোন ডাক্তার এই মুহূর্তে আপনাকে সেবা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত রয়েছেন। সেইসঙ্গে ডাক্তারের সঙ্গে অডিও বা ভিডিও কলে কথা বলতে পারবেন রোগী এবং নিতে পারবেন প্রেসক্রিপশানসহ যাবতীয় চিকিত্সাসেবা। হাসপাতাল থেকে শুরু করে সেবাদানকারী ডাক্তারের সব ধরনের তথ্য, অ্যাপয়েন্টমেন্ট, সিরিয়াল সম্পর্কিত তথ্যাদি সংযুক্ত করা হয়েছে অ্যাপটিতে। হসপিটালিনের শুরুটা ছিল চার বন্ধুর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থেকে। একেবারেই নিজস্ব অর্থায়ন, পরিকল্পনা, এমনকি ডক্টরস ব্লগ ও মেইলে ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থেকে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের প্রশ্নের উত্তর। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি অল্প সময়েই পৌঁছে গেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসকের কাছে।
এখানেই শেষ নয়, প্রতিটি ডাক্তারের বিডিএমসি নম্বর চেক করা থেকে শুরু করে সার্টিফাইডের প্রতিটি কাজ সমপন্ন করেছেন উদ্যোক্তরা নিজে। ড. আব্দুল্লাহ বীন সাঈদ বলেন, ‘অ্যাপ বানানোর উদ্যোগের শুরুতে আমি ছিলাম না। এর সূচনা হয়েছিল কো-ফাউন্ডার এবং লিড অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপার ডা. যুবায়েরের হাত ধরে। আর তার সেই উদ্যোগের আরেক সারথি ছিলেন রিয়াজুস সালেহীন; যিনি কো-ফাউন্ডার এবং লিড ওয়েব ডেভেলপার। আমি তার অল্প কিছুদিন পরেই যুক্ত হলাম, একেবারে কাকতালীয়ভাবে। রোগী দেখতে যেতে যেতে প্রথম আইডিয়া শেয়ারিং হয় আমার আর যুবায়েরের মধ্যে।
এরপর আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ডা. নাঈম; কো ফাউন্ডার এবং ডেন্টিস্ট্রির পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। আমাদের চারজনের ছোট্ট একটা টিম দাঁড়িয়ে গেলো। এরপর লম্বা এক পথপরিক্রমায় একে একে যুক্ত হলেন মো. আশরাফুল আসাদ এবং শাহরিয়ার নাসিম নাফি। সব মিলে এই ছয় কাঁধের উপর ভর করেই দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে হসপিটালিন। অ্যাপের লিড প্রোগ্রামার ডা. যুবায়ের বলেন, ‘আপনি অ্যাপ ওপেন করলেই দেখবেন গুগল ম্যাপ; প্রথমে মনে হবে এটা রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কি না! মূলত নিকটস্থ ডাক্তারের চেম্বার বা আইসিইউ—এগুলো ইউজারের জিপিএস লোকেশনের ভিত্তিতে দেখানো হয়। এবং ইউজার সার্চ দিয়েই বুঝতে পারেন একজন ডাক্তারের চেম্বার অথবা আইসিইউ ঠিক কোথায় আছে, কীভাবে যেতে হবে।’
শুরুর দিকে অ্যাপের রেগুলার টেস্টিং করে যাচ্ছিলেন ডা. সাঈদ এবং ডা. বেলায়েত। এরইমধ্যে করোনার প্রকোপ শুরু হয়ে গেল। তবে অডিও ভিডিও কলের মাধ্যমে ডাক্তার দেখানোর বিষয়টা তখনও হসপিটালিনে যুক্ত হয়নি, প্ল্যানও ছিল না। কিন্তু করোনাকালে ডাক্তার দেখানোর বিষয়টা রোগীর জন্য কঠিন হয়ে গেল। ডাক্তাররাও চেম্বারে বসছেন না। এমনটি মাথায় রেখেই অডিও ভিডিও কল অ্যাড করা হলো অ্যাপে। যেন ঘরে বসে অনলাইনেই ডাক্তারকে দেখাতে পারে রোগীরা। অ্যাপ রিলিজের এক সপ্তাহ আগে ডা. সাঈদ প্রস্তাব করেন অ্যাপে আইসিইউ সার্চের অপশন অ্যাড করলে কেমন হয়? কথামত কাজ। প্রায় ৮০টিরও বেশি আইসিইউর ম্যাপ লোকেশন এবং হটলাইনসহ ইনফো অ্যাড করা হলো। সবকিছু রেডি হওয়ার পর গত ৪ মে রিলিজ করা হয় অ্যাপটি। প্রথমে চিকিৎসকদের ফেসবুক গ্রুপে দেওয়া হয় এবং অভূতপূর্ব সাড়া পেতে থাকে হসপিটালিন।
ডা. বেলায়েত বলেন, ‘প্রতিদিন দুই শতাধিক চিকিত্সকের প্রোফাইল ভেরিফিকেশন রিকোয়েস্ট আসত। দিন-রাত ঘুম উপেক্ষা করে সব ডকুমেন্ট যাচাই করে সেগুলো অ্যাপ্রুভ করতাম আমরা তিন চিকিৎসক।’ বিএমডিসি সার্টিফিকেট চেক করাসহ যারা সেপশালিস্ট হিসেবে অ্যাপ্লাই করেছেন তাদের পোস্টগ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট যাচাইয়ের কাজও করছেন এই তিন উদ্যোক্তা চিকিত্সক। এখন পর্যন্ত হসপিটালিন অ্যাপে নিবন্ধিত চিকিৎসক সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। অর্ধশতাধিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যুক্ত হয়েছেন এই অ্যাপে এবং প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছেন। তালিকায় রয়েছেন সরকারি মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল বিষয়ের বিভাগীয় প্রধানরাও।
কো-ফাউন্ডার রিয়াজুজ সালেহীন বলেন, ‘প্রথম থেকেই পরিকল্পনা ছিল একজন চিকিত্সক হিসেবে আমি যা প্রত্যাশা করেছি, তার সবটা যেন পূরণ করতে পারে হসপিটালিন। এখন পর্যন্ত আমাদের চিকিৎসক কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের সেই প্রাথমিক লক্ষ্যে সফল হতে পেরেছি।’
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, অ্যাপসটি খুব শিগগিরই সেবা ও গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দেশ তথা সারা বিশ্বে আলো ছড়াবে।
ইত্তেফাক/জেডএইচডি