শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইসলামে মেহমানদারির গুরুত্ব

আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২১, ১১:০০

মেহমানদারিকে ইসলামে উত্তম গুণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবিজি (স) মেহমানের সম্মান করতে তাকিদ দিয়েছেন। মেহমানের যথাযথ আপ্যায়ন ও কদর করা একজন মুসলমানের ইমানি কর্তব্য। নবিজি (স) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানের সমাদর করে।’ (বুখারি, হাদিস :৬১৩৬) অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘যে মেহমানদারি করে না, তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস :১৭৪১৯) আরেক হাদিসে নবি করিম (স) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ... নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস :৬১৩৪)

আল্লাহর নবি ইবরাহিম (আ) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে মেহমানদারির প্রথা চালু করেন। আতিয়্যা আওফি (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (স)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ)-কে এ কারণে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন যে, তিনি মানুষকে খানা খাওয়াতেন, বেশি বেশি সালাম দিতেন আর মানুষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি নামাজ আদায় করতেন। (তাম্বিহুল গাফিলিন)

একবার বনু গিফার গোত্রের এক লোক রাসুল (স)-এর মেহমান হলেন। মহানবি (স) আগের দিন অভুক্ত ছিলেন। যেদিন মেহমান এলেন, সেদিন ঘরে ছাগলের দুধ ছাড়া আর কিছু ছিল না। নিজে অনাহারী হয়েও আমাদের রাসুল (স) সেই মেহমানকে ছাগলের দুধের সবটুকু খাওয়ালেন। কিন্তু অতিথিকেও বুঝতে দিলেন না যে, তিনি ক্ষুধার্ত। এজন্য মেহমান এলে খুশি হওয়া উচিত। অন্তরে সংকীর্ণতা রাখা অশোভনীয়। মেহমান আল্লাহর রহমত ও বরকত নিয়ে আসে। আল্লাহ যাকে মেহমান হিসেবে পাঠান, তার রিজিকও পাঠিয়ে দেন। তাদের ভাগ্যে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির আগেই এই রিজিক লিখে রেখেছেন।

পবিত্র কোরআনে মেহমানদারি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যদিও বা নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। আর যারা স্বভাবজাত লোভ-লালসা এবং কামনা থেকে মুক্তি লাভ করে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯) নবিজি (স) বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত খাবারের দস্তরখান মেহমানের সামনে বিছানো থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা মেজবানের জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন।’(আল মুজামুল আওসাত)

মেহমানদারি বলতে শুধু পেট ভরে খাওয়ানো নয়; বরং পরস্পর মানবিকতা, হৃদ্যতা ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ উদ্দেশ্য। মেহমানদারির শিষ্টাচারের প্রতি যত্নবান হলে মেহমানদারিটা মেজবানের ওপর ভারি কিংবা কষ্টকর মনে হবে না। সুরা আহজাবেও এ ধরনের কিছু শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! নবির ঘরে (অনুমতি ছাড়া) প্রবেশ কর না। অবশ্য তোমাদেরকে আহার্যের জন্য আসার অনুমতি দেওয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। কিন্তু যখন তোমাদেরকে দাওয়াত করা হয় তখন যাবে। তারপর যখন তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে তখন আপন-আপন পথ ধরবে; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়বে না।’ (সুরা আহজাব : ৫৩)

আপ্যায়নের সময়সীমা

এ ব্যাপারে নবিজি (স) বলেন, ‘আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ইমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে এবং তার হক আদায় করে। নবি (স)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মেহমানের হক কী? তিনি বললেন, এক দিন এক রাত, সর্বোচ্চ মেহমানদারি তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত, এর অতিরিক্ত হলো সদকা।’ (বুখারি) মুসলিম শরিফের একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এত বেশি অবস্থান করা- যা তাকে গুনাহগার বানিয়ে ফেলে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাকে গুনাহগার কিভাবে বানিয়ে ফেলে। নবিজি (স) বলেন, ‘তার নিকট অবস্থান করতে থাকল, আর তার কাছে কিছুই থাকল না- যা দ্বারা তাদের মেহমানদারি করবে।’ এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ) বলেন, মেহমানের হক তিনটি- ১. একদিন একরাত মেহমানদারি করা ওয়াজিব। ২. দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন মুস্তাহাব। ৩. তৃতীয় দিনের পর মেহমানদারি করা সদকা বা অনুগ্রহ।

আল মুগনিল লাবিব গ্রন্থে আছে, এ হকগুলো মুসাফির এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত মেহমানের জন্য প্রযোজ্য। নিজের এলাকার মেহমানের মেহমানদারি করা মেজবানের ইচ্ছাধীন। চাইলে তার জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, আবার চাইলে মেহমানদারি না করারও সুযোগ আছে। খাবারের সময়কে লক্ষ করে কোনো বন্ধু কিংবা কারও বাসাবাড়িতে যাওয়া অশিষ্টাচারপূর্ণ। কারও ঘরে খাবারের সময় পর্যন্ত বসে থাকাও অভদ্রতা। এতে করে ঘরের মালিককে পেরেশান হতে হয়। মেহমানের উপস্থিতিতে তাদের খাওয়া-দাওয়ার পরিবেশ থাকে না। আবার সবার পক্ষে যতজন লোকই বাসায় আসুক তাদেরকে আপ্যায়ন করার সামর্থ্যও থাকে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের অনর্থক অভ্যাস থেকে নিষেধ করেছেন।

লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন