সমাজসভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নর-নারী, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব অথবা সাদা-কলোর কোনো পার্থক্য নেই।
পার্থক্য কেবল তাকওয়া বা আল্লাহভিরুতায়। ইসলাম এসেছে কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য নয়, বরং একটি সংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য, যেখানে একটি পৌত্তলিক সংস্কৃতিক আবহমান ঐতিহ্যের বিপরীতে একত্ববাদী আল্লাহভক্ত সমাজ গড়ে ওঠে। যে জীবনবিধানে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেন রসুল মোহাম্মদ (স)। তিনি আরব সমাজে মানবতাবিরোধী প্রচলিত অনেক কুসংস্কারে ধ্বংসের ভিত্তিমূলে গড়ে তোলেন এক বিস্ময়কর মানবতাবাদী জীবনব্যবস্থা, তথা ইসলামি সমাজ।
অনেক সংস্কারের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল মানবতার দুটি ধারার একটি, তথা অবদমিত ও নির্যাতিত নারী সমাজের আমূল সংস্কার এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। যে সমাজে নারীরা যৌনদাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেত, যাদের সামাজিক ও পরিবারিক কোনো অধিকার ছিল না, রসুল (স) মাত্র ২৩ বছরের নবুয়তি জিন্দেগিতে ইসলামের পরশে সে নারীই সবচেয়ে মর্যাদার আসনে বসেছিল, শ্রেষ্ঠ উপাধি পেল আবার ইসলামি শরিয়াহর এক-তৃতীয়াংশের ব্যাখ্যাকার হিসেবে স্বীকৃতি পেল।
অত্যন্ত দুঃখ আর বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, এখন অধিকাংশ মুসলিম সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রে নারীর ব্যাপারে ইসলামের সেই নীতির প্রতিফল তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
পশ্চিমা সভ্যতায়, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় ইলামফোবিয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো ইসলামে নারী অধিকার নেই। নারীদের ঘরবন্দি করা হয় এবং দাসীর মতো আচরণ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক মুভি ‘দ্য মেসেজ’-এর নির্মাতা আরব-আমেরিকান মস্তুফা আক্কাদ আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনার সময় ইসলাম সম্পর্কে একটি জাতির এরূপ ভ্রান্ত ধারণা দেখে ব্যথিত হন। তিনি হলিউডের অন্যতম পরিচালক হিসেবে তত দিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হেরর ‘হেলোইন’ সিরিজের পরিচালক সেই মস্তুফা আক্কাস ‘দ্য মেসেজ’ মুভিতে ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীর জীবন কবরের প্রসঙ্গ এনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রসুল (স)-এর চেষ্টার বিষয়গুলো সুন্দর করে তুলে ধরেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ছিলেন রসুল (স)-এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা)। এবং তিনিই রসুল (স) কে প্রথম অভয়দানকারী।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে অপমানিত করবেন না।’ নিশ্চয়ই এতে কল্যাণ রয়েছে। মস্তুফা আক্কাদ তার মুভিতে প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মাতা সুমাইয়ার অপর দুই বোনকে তার পিতা তথা খাইয়াত কর্তৃক হত্যার হূদয়বিদারক বর্ণনা তুলে ধরেছেন এবং ইসলামের সুদিনে নয়, বরং নির্যাতনের সময়ই রসুল (স) নারী হত্যা, মেয়েশিশুর জীবন্ত কবরদান বন্ধ, এমনকি তাদের পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার কথা অত্যন্ত সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে ইউরোপীয় বা অন্য ধর্মের প্রভাবিত সমাজে নয়, বরং মুসলিম সমাজেও ইসলাম প্রদত্ত নারীর অধিকারকে অনেক সময় স্বীকার করা হয় না। রসুল (স)-এর স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা) রসুল (স)-এর সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তৃতীয়। সমস্ত ফকিহ দিনের এক তৃতীয়াংশ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আয়েশা (রা)-কে স্বীকার করে নিয়েছেন। নারীদের ইসলাম শেখানোর জন্য রসুল (স) সপ্তাহে এক দিন সময় দিতেন। অথচ আজকের দিনেও ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
কিছুটা বয়স হলে ধর্ম রক্ষার নামে অল্প বয়সেই এসব মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, ধর্মের নামে স্পষ্টতই এ জাতি কুসংস্কারে নিমজ্জিত রয়েছে, বিশেষ করে নারীর ব্যাপারে। নারীর শিক্ষার ব্যাপারে তাদের সামাজিক সচেতনতা একেবারেই নেই, বরং তারা মনে করে নারীরা সাবালক হলেই বিবাহিত হবে আর সন্তান জন্ম দেবে। ক্যাম্প-জীবনেও তাদের জন্মহার রেকর্ড পরিমাণ। আমাদের সমাজেও ধর্মের নামে অনেকে নারীকে উচ্চশিক্ষিত করতে বাধা দেন।
ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে শিক্ষা জায়েজ নয় বলে ফতোয়া দেন আর অন্য ধর্মের লোকদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ বৈধ নয় বলেও ফতোয়া দেন। অথচ এসব লোক জানেনই না বদরের যুদ্ধের বন্দিদের মুসলমান শিশুদের পড়ানোর শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল আর তারা সবাই অমুসলিম ছিলেন। আজকের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় যে মসজিদ কেন্দ্রিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফাতেমীয়রা এর নাম দিয়েছিল ‘ফাতেমাতুজ জোহরা’র নামে। জোহরা থেকে আল-আজহারের ব্যপ্তি।
অনেক সময় ওয়াজের নামে কিছু বক্তৃতা শুনে আশ্চার্যান্বিত হতে হয়। ওয়াজে এমনভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়, যা রীতিমতো অপমানকর। তাদের বাইরে যাওয়া বা কর্মে সংযুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে এদেশীয় কিছু ওয়াজিনিনের কথার কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামের নামে চালিয়ে দেওয়া এসব বকধার্মিকের বক্তৃতায় ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে কোরআন-হাদিসে নারীর কর্মে যোগদানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই। রসুল (স)-এর আমলে নারী সাহাবিরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। রসুল (স)-এর স্ত্রী খাদিজা (রা)-সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের স্ত্রীকে রসুল (স) তার উত্পাদিত বা তৈরী করা পোশাক বাজারে বিক্রির ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছিলেন। কাজের জন্য ঘরের বাইরে যেতে হলে ইসলামি বিধানে নির্ধারিত ড্রেস কোড মেনে বাইরে যাওয়া যাবে। বাইরের কাজের ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া থাকতে হবে। কেননা, পরিবার ও সন্তান-সন্ততি দেখভালও একটি দিনি দায়িত্ব। কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী জাহেলি সমাজের নারীদের অনুরূপ বাইরে যাওয়া যাবে না।
আজকাল সারা বিশ্বে এমনকি সৌদি আরবের ইমিগ্রেশনসহ নানাবিধ কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ সত্যিই আশাব্যঞ্জক। নারীর ক্ষমতায়নে এটা অগ্রগতি। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ হাজি হজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন বায়তুল্লাহ তাওয়াফে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেখানে সমানতালে নামাজও পড়া যায়। সমস্যা কেবল আমাদের দেশসহ ভারত ও পাকিস্তানে। আমরা ধর্মীয় স্কলারগণ ইসলামি ফ্রেমের মধ্যে থেকে নারীরা সমাজে আরো অবদান রাখুক বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারি না।
এই না মেনে নেওয়ার বিষয়টিই কুসংস্কার বা বাড়াবাড়ি। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে মুসলিম নারী সমাজের ব্যাপারে আমাদের ইসলামি স্কলারদের আরো সচেতন হতে হবে। ইসলামের নির্দেশনাগুলো আরো বেশি করে আত্মস্ত করে বর্তমান সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব অনেক বেশি।
আরেকটি বিষয়ে আমাদের সমাজে ইসালিক স্কলার বা সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানের মধ্যে নীরব ঐক্য দেখা যায়। ইসলাম উত্তরাধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে কোরআনে নারী সমাজের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। অর্থাৎ, পৈতৃক সম্পত্তিতে ইসলাম মেয়েদের অধিকার স্পষ্টতই নির্দিষ্ট করেছে। বাংলাদেশ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও মসজিদের দেশ হওয়ার পরেও এই নির্ধারিত ফরজের ৫ শতাংশও বাস্তবায়িত হয় না। ইনিয়ে-বিনিয়ে ভাইয়েরা মিলে সব সম্পত্তি বণ্টন করে নেয় এবং বোনদের বঞ্চিত করে।
তবে এর ব্যতিক্রম আছে, তবে সংখ্যা একেবারেই কম। আজকে নামাজ ও রোজার ফরজের ব্যাপারে এমনকি কোনো নফল পালনের ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারগণ যেভাবে বয়ান করেন, এর কিয়দাংশ যদি এই উত্তরাধিকার বিষয়ের ওপর বর্ণনা করতেন, তাহলে সমাজে নারীর বঞ্চনা অনেকাংশে লাঘব হতো। এরূপভাবে বিয়ের ক্ষেত্রেও কনের অনুমতির কথা স্পষ্ট বলা হলেও আমরা অভিভাবকেরা বেমালুম ভুলে যাই। নিজের ইচ্ছামতো মেয়েকে পাত্রস্থ করার চেষ্টা করি। মোহরানা ঠিকমতো আদায় করি না।
যুদ্ধক্ষেত্রেও নিরাপরাধ নারী ও শিশুর ওপর হামলা বা নির্যাতন করা যায় না। আর আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যা দেখছি, তাতে অনেক সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় আঁতকে উঠতে হয়। আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো আজও নারী শিশুর জন্ম হলে আমাদের মুখ কালো হয়ে যায়। তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্য করি। ইদানীং সুন্নাহ পুনরুজ্জীবনের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি চার বিবাহকে বেশি করে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
এটা অবশ্যই সুন্নাহ। তবে এমন পর্যায়ের সুন্নাহ নয়, যা পালনের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তদুপরি কোরআনে দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি চতুর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শর্তযুক্ত করা হয়েছে। এই ন্যায়বিচারের ভেতরে অনেক বিষয় নিহিত আছে। ন্যায়বিচার করতে না পারলে একের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে।
বুখারি ও মুসলিমের এক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানতে চাই। রসুল (স)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, পিতা-মাতার কাছে কে বেশি সম্মানীয়। রসুল (স) তিন বার মায়ের কথা বলেছেন আর এক বার বাবার কথা বলছেন। সম্মানীয় এই নারী সমাজকে ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আরো বেশি দক্ষ করে তোলার মধ্যেই আমাদের সভ্যতার সামনে এগিয়ে যাওয়ার বীজ নিহিত।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারফেইথ স্কলার।
ইত্তেফাক/এএএম